মঙ্গলবার, নভেম্বর ১১, ২০২৫
No menu items!
বাড়িখেলাধুলামেসির ফুটবল ক্যারিয়ারের শেষ চুক্তি: কীভাবে হলো সবকিছু

মেসির ফুটবল ক্যারিয়ারের শেষ চুক্তি: কীভাবে হলো সবকিছু

চুক্তি হতোই। অপেক্ষা ছিল শুধু আনুষ্ঠানিকতাটুকু সেরে ফেলার। সেই অপেক্ষা ঘুচে যাওয়ার প্রথম ইঙ্গিতটা মেলে ২১ অক্টোবর মঙ্গলবার বিকালে। মায়ামি আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের পাশে ১০০ কোটি ডলার খরচে মায়ামি ফ্রিডম পার্ক স্টেডিয়াম বানানোর কাজ করছিলেন নির্মাণশ্রমিকেরা। ইঙ্গিতটা তাঁদের দেওয়া হয় সবার আগে।

নির্মাণশ্রমিকদের জানানো হয়, বুধবার কাজে একটু বিঘ্ন ঘটবে। তবে কাজকর্ম যেন স্বাভাবিকভাবেই চালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করা হয়। কিন্তু পরের দিন (বুধবার) নির্মাণশ্রমিকদের চক্ষু চড়কগাছ। কাজে বিঘ্ন ঘটার যে বার্তা দেওয়া হয়েছিল এবং যে কারণে বিঘ্ন ঘটবে, সেই দুজন এসে হাজির। ইন্টার মায়ামির সহমালিক ও এক সময় দুনিয়াজুড়ে খ্যাতি কুড়ানো ফুটবলার ডেভিড বেকহাম ও মায়ামি তারকা লিওনেল মেসি! তাঁরা একটি ভিডিও শুট করবেন, যেটার মাধ্যমে মায়ামিতে মেসির নতুন চুক্তি জানানো হবে বিশ্বকে।

নির্মাণশ্রমিকেরা শুরুতে দুজনের থেকে একটু দূরত্ব বজায় রেখে কাজ করে গেলেন। কিন্তু ভিডিও শুট শেষ হওয়ার পর দেখা গেল মেসি তাঁদের নির্মাণকাজের হেলমেটে সই করছেন সেই ভবনে, যেটা তাঁর নামে শিগগিরই উদ্বোধন করা হবে।

আগের রাতেই (রাত ৯টা) চুক্তির সব কাগজপত্র চূড়ান্ত করে পাঠানো হয় মেজর লিগ সকার কর্তৃপক্ষের কাছে। এর মাধ্যমে আনুষ্ঠিকভাবে নিশ্চিত হয় সেই দীর্ঘ প্রত্যাশিত খবরটি, যা কয়েক মাস আগেই নিশ্চিত করা হয়েছিল—আর্জেন্টাইন কিংবদন্তি ইন্টার মায়ামিতেই থাকছেন। প্রত্যাশার চেয়েও বেশি সময়ের জন্য।

সবকিছু ঠিক থাকলে তিন বছরের এই চুক্তিতে মেসিকে ইন্টার মায়ামির গোলাপি জার্সিতে দেখা যাবে তাঁর ৪২তম জন্মদিনের কয়েক মাস আগপর্যন্ত।

ভিডিও ধারণের জায়গা হিসেবে ইন্টার মায়ামির নতুন স্টেডিয়াম বেছে নেওয়া কাকতালীয় ঘটনা নয়। মায়ামির ভবিষ্যৎ এমনকি ক্লাবটির সঙ্গে মেসির আর্থিক চুক্তিও সরাসরি জড়িত তাঁর আগামী মৌসুমে এই স্টেডিয়ামে থাকার সঙ্গে। মেসি মাঠে থাকা মানে মায়ামির টিকিট পড়ে থাকবে না। সাধারণ আসনের পাশাপাশি ভিআইপি আসনগুলোও বিক্রি করা সহজ হয়ে যায়। স্টেডিয়ামের ভেতরে বাণিজ্যিক কার্যক্রমের মূল্য যেমন বাড়ে তেমনি নামকরণ চুক্তির মূল্যও হয় আকাশচুম্বী। মেসির বাণিজ্যিক গুরুত্বের ধারেকাছেও কেউ নেই।
তবে ইন্টার মায়ামির যেখানে লাভ, সেখানে মেসিরও লাভ।

নতুন এই চুক্তির ফলে মেসির ইন্টার মায়ামির লঘু অংশীদারত্ব নেওয়ার সম্ভাবনা আরও জোরদার হলো। মায়ামির সঙ্গে আর্জেন্টাইন কিংবদন্তির (২০২৩ সালে প্রথম চুক্তি) চুক্তির আগে ‘স্পোর্টিকো’র হিসাবে ক্লাবটির বাজারমূল্য ছিল ৫৮ কোটি ৫০ লাখ ডলার। গত বছর ফোর্বসের করা হিসাবে সেটি ১২০ কোটি ডলার। এখন নতুন স্টেডিয়াম এবং সেখানে যেহেতু মেসি থাকবেন, তাই মায়ামির সব রকম কার্যক্রমের বাণিজ্যিক মূল্যও আরও বাড়বে। পাশাপাশি বাড়বে মেসির অংশীদারত্বের মূল্যও।

যুক্তরাষ্ট্রে মেসির অধ্যায় শুরু হয়েছিল ২০২৩ সালে দুর্দান্ত ফ্রি–কিক থেকে জয়সূচক এক গোলে। মোহজাগানিয়া সেই পারফরম্যান্স বিস্তৃত হতে হতে এখন সেটা সব মিলিয়ে সাড়ে পাঁচ মৌসুম স্থায়ী হবে। তবে নতুন এই চুক্তির মেয়াদ ফুরানোর পর মেসির ঠিকানা না পাল্টানোর সম্ভাবনাই বেশি। খেলা ছাড়ার পর বেকহামের মতোই মেসি ব্র্যান্ড এমএলএস এবং আমেরিকান ফুটবলের সঙ্গে অনেক বছর সংযুক্ত থাকবে।

মায়ামির প্রকাশ করা ভিডিওতে ক্লাবটির সহমালিক হোর্হে মাস বলেন, ‘পরবর্তী অধ্যায় শুধু অতীত দেখার নয়। লিওনেলকে পেয়ে যা অর্জিত হয়েছে, তার চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো, সামনে যা আসছে। এখানে আমরা একসঙ্গে অনেক সুন্দর অধ্যায়ের সাক্ষী হব।’

চুক্তি নিয়ে মেসি ও মায়ামি দুই পক্ষের আইনজীবীদের সূক্ষ্ম দিকগুলো চূড়ান্ত করতে গত কয়েক মাস লেগেছে। এ সময়ে মাঝেমধ্যে গুঞ্জন শোনা গেছে, মেসি সৌদি আরব কিংবা আর্জেন্টিনায় ফিরছেন। এসব শুনে মেসি ও মায়ামি–সংশ্লিষ্টরা হেসেই উড়িয়ে দিয়েছেন। অল–স্টার ম্যাচে না খেলায় মেসিকে সাময়িকভাবে নিষিদ্ধ করা হয়েছিল। অনেকে ভেবেছিলেন, ব্যাপারটি হয়তো চুক্তিতে প্রভাব ফেলতে পারে। কিন্তু কিছুই ঘটেনি। চুক্তি তখন প্রায় সম্পূর্ণই হয়ে গিয়েছিল।

হোর্হে মাসের ভাষায়, মেসি ঠিক সেই চুক্তিতেই সই করেছেন যেটা তাঁর ক্যারিয়ারের শেষ চুক্তি হতে পারে। কয়েক সপ্তাহ আগেই দুই পক্ষের মধ্যে সমঝোতা সম্পন্ন হয়। শেষ ধাপে চুক্তিটি পর্যালোচনা করে এমএলএস, তাদের অংশীদার সংস্থা ও এমএলএস প্লেয়ার্স অ্যাসোসিয়েশন। গত সপ্তাহের শুরুতেই এমএলএস চুক্তিটিতে আনুষ্ঠানিক অনুমোদন দেয়, এরপরই ঘোষণা আসে প্লে-অফের উদ্বোধনী ম্যাচের ঠিক আগে।

চুক্তির ঘোষণা আসার পর অনেকেই ধারণা করেছিলেন, মেসি ৪০ বছর পেরিয়েও খেলবেন—এই কথার অর্থ হলো আর্জেন্টিনার হয়ে আগামী বিশ্বকাপেও তাঁকে দেখা যাবে। ‘দ্য অ্যাথলেটিক’–এর তথ্যমতে, মেসি ২০২৬ বিশ্বকাপে খেলার বিষয়ে এখনো চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেননি (মেসি এনবিসিকে গতকাল দেওয়া সাক্ষাৎকারে জানিয়েছেন, ২০২৬ বিশ্বকাপে খেলতে চান)।

মেসি এবং তাঁর পরিবার যুক্তরাষ্ট্রের জীবন বেশ উপভোগ করছেন। ক্লাব বিশ্বকাপে মায়ামির এবারের পারফরম্যান্স তাঁর চিন্তাভাবনা পাল্টে দিয়েছে। এমএলএসে নিজের ‘লিগ্যাসি’ নিয়ে তাঁর ভাবনা এখন ভিন্ন, মেসির ঘনিষ্ঠরা এমনটাই জানিয়েছেন। মেসি বুঝেছিলেন, ইউরোপের শীর্ষ ক্লাবগুলোর সঙ্গে ক্লাব বিশ্বকাপে টক্কর দেওয়া মায়ামির পক্ষে সম্ভব নয়। তবু যুক্তরাষ্ট্রে সেই উদ্বোধনী টুর্নামেন্টের কিছু একটা মেসির ভেতরটা নাড়িয়ে দেয়।

এই ভাবনা থেকেই ‘মেসি কাপ’ যুব টুর্নামেন্ট আয়োজনের ভাবনাটা ভেবেছেন মেসি। যেখানে মায়ামির অনূর্ধ্ব–১৬ দলের সঙ্গে অংশ নেবে আতলেতিকো মাদ্রিদ, বার্সেলোনা, চেলসি, ইন্টার মিলান, ম্যানচেস্টার সিটি, নিউওয়েলস ওল্ড বয়েজ ও রিভার প্লেট। টুর্নামেন্টটি অনুষ্ঠিত হবে আগামী ডিসেম্বরে চেজ স্টেডিয়ামে। ভবিষ্যতের আসরগুলোয় আরও এমএলএস একাডেমি দলকে আমন্ত্রণ জানানোর কথাও চলছে।

সহজ কথায়, এমএলএসের দলগুলো বিশ্বসেরা ক্লাবগুলোর বিপক্ষে আরও প্রতিদ্বন্দ্বিতা গড়ে তুলুক—এটাই চাওয়া মেসির। এমন না যে এই প্রথমবার এমএলএসের একাডেমি দলগুলো শীর্ষ পর্যায়ের আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায় অংশ নিল। আগের দশকগুলোয় ডালাস কাপ জেনারেশনাল অ্যাডিডাস কাপ আয়োজিত হয়েছে। কিন্তু মেসির সরাসরি তত্ত্বাবধানে যুব টুর্নামেন্টে নিজের নাম জড়িয়ে এটা বুঝিয়েছেন, যুক্তরাষ্ট্রের ফুটবল ও লিগকে এগিয়ে নিতে তিনি সক্রিয় ভূমিকা রাখছেন।

 

যেকোনো মানদণ্ডেই মেসি এমএলএসে সফল। বাণিজ্যিকভাবে অভূতপূর্ব প্রভাব ফেলেছেন, ইন্টার মায়ামিকে পরিণত করেছেন বৈশ্বিক ব্র্যান্ডে। মায়ামির গোলাপি জার্সি এখন বিশ্বজুড়ে ফুটবলের ইতিহাসে খ্যাতনামা ক্লাবগুলোর মতোই পরিচিত। পুরো উত্তর আমেরিকা মহাদেশজুড়ে মেসি স্টেডিয়ামগুলো দর্শকে ভরেছেন। ইন্টার মায়ামির আয়ও এখন আকাশছোঁয়া, তেমনি ক্লাবের বাজারমূল্যও।

কতগুলো ট্রফি জিতেছেন—সেই হিসাব করে উত্তর আমেরিকায় মেসির ‘লিগ্যাসি’ বিচার করা হবে না। বরং অবসর নেওয়ার পরও কীভাবে তাঁর প্রভাব সেখানে স্থায়ী হয়েছে, সেটা দেখা হবে।
গত সপ্তাহে মায়ামির ফ্রিডম পার্কে ভিডিও ধারণের সময় মেসির পরিবারও উপস্থিত ছিল। বেকহামও তাঁর মা–বাবাকে মায়ামিতে উড়িয়ে এনেছিলেন। একদম পারিবারিক সম্মিলন বলতে যা বোঝায় আরকি। মায়ামির চার মালিক—হোর্হে ও জোসে মাস, বেকহ্যাম এবং মেসি—স্টেডিয়াম ঘুরে দেখেন এবং ভবন সম্পূর্ণ হলে কোথায় কী হবে, সেসব নিয়েও কথা বলেন।
এটা এমন এক প্রকল্প যেটা নিশ্চিত করে মেসি ও মায়ামি এখন একই বৃন্তে দুটি কুসুম।

Notify of
guest
0 Comments
সবচেয়ে পুরাতন
সবচেয়ে নতুন Most Voted
Inline Feedbacks
View all comments
আরো দেখুন

কখন অবসর নেবেন জানালেন রোনালদো

হন্ডুরাসের জালে ব্রাজিলের ৭ গোল

জনপ্রিয় সংবাদ