ধাক্কাটা দিয়েছিলেন উরুগুয়ের মিডফিল্ডার নিকোলাস দে লা ক্রুজ। সেই ধাক্কার তীব্রতা এতটাই যে দুই বছরের মধ্যে জাতীয় দলে ফিরতে পারলেন না নেইমার! ব্রাজিলের সমর্থকেরা কিছুদিন আগপর্যন্তও হয়তো এভাবে ভেবেছেন। কিন্তু ভাবনাটা পাল্টেছে কিংবা দিন দিন পাল্টে যাচ্ছে।
তারিখটা ২০২৩ সালের ১৮ অক্টোবর। উরুগুয়ের সেন্টেনারিও স্টেডিয়ামে বিশ্বকাপ বাছাইয়ের ম্যাচে স্বাগতিকদের মুখোমুখি ব্রাজিল। ৪৪ মিনিটে দে লা ক্রুজের ধাক্বায় মাটিতে পড়ে ব্যথায় কাতরাতে থাকেন নেইমার। স্ট্রেচারে করে মাঠ ছাড়েন কাঁদতে কাঁদতে। ব্রাজিলের জার্সিতে সেটাই ছিল নেইমারের শেষ দৃশ্য। পরে জানা গেল, বাঁ পায়ের লিগামেন্ট এবং মিনিসকাসিস ছিঁড়ে গেছে, মারাত্মক এসিএল চোট। তখন সবাই জানতেন, খুব দ্রুতই মাঠে ফেরা হচ্ছে না নেইমারের। প্রশ্ন উঠেছিল, তাঁর জাতীয় দলে ফেরার প্রক্রিয়াটা কি হবে?
সেই চোটের দুই বছর পূর্ণ হলো আজ।
জাতীয় দলে ফেরা দূর অস্ত, নেইমারের মাঠে ফেরা নিয়েই এখন অনেকে শঙ্কায় ভুগছেন। বারবার চোট পেলেও যেহেতু ফেরার প্রক্রিয়ার মধ্যে আছেন, তাই নেইমার হয়তো একদিন মাঠে ফিরবেন। কিন্তু এর মধ্যেই খুব গুরুত্বপূর্ণ একটি প্রশ্নও লুকিয়ে রাখা যাচ্ছে না—নেইমার কি আর কখনো ব্রাজিলের জার্সিতে ফিরতে পারবেন?
এমন না যে নেইমারকে ছাড়া ব্রাজিল জাতীয় দল খুব ভালো করছে, তাই দলে তাঁর জায়গা নেই। ব্রাজিল কোচ কার্লো আনচেলত্তি বারবার বলেছেন, নেইমারের জন্য ‘জাতীয় দলের দরজা খোলা’। তবে একটি শর্তও বেঁধে দিয়েছেন, জাতীয় দলে ফিরতে নেইমারকে ‘পুরোপুরি ফিট হতে হবে’—যা গত দুই বছরে হয়নি।
অথচ বিশ্বকাপ ফুটবল শুরু হতে আর বেশি সময় বাকি নেই। আগামী জুনে যুক্তরাষ্ট্র, মেক্সিকো ও কানাডায় শুরু হবে ২৩তম ফিফা বিশ্বকাপ। চলতি মাস থেকে প্রস্তুতির অংশ হিসেবে প্রীতি ম্যাচ খেলতে শুরু করেছে ব্রাজিল। আগামী মাসেও আফ্রিকান দুটি দলের বিপক্ষে প্রীতি ম্যাচ আছে। এ দুটি ম্যাচেও নেইমারকে ব্রাজিল জাতীয় দলে না দেখার সম্ভাবনাই বেশি। ওদিকে আনচেলত্তি জানিয়ে দিয়েছেন, এসব প্রীতি ম্যাচ থেকেই তিনি বিশ্বকাপের দল চূড়ান্ত করবেন, আগামী মার্চের মধ্যে ঠিক হয়ে যাবে একাদশও।
নেইমারকে ছাড়া ব্রাজিল যে একদম খারাপ করছে, তা নয়। তাঁর অনুপস্থিতিতে ভিনিসিয়ুস-রাফিনিয়ারা ‘দশে মিলে করি কাজ’ মানসিকতায় খেলছেন। প্রমাণ দিচ্ছে পরিসংখ্যান—উরুগুয়ের বিপক্ষে নেইমার সেই চোট পাওয়ার পর ব্রাজিল এ পর্যন্ত ২৪ ম্যাচ খেলেছে। ১০ জয়ের পাশাপাশি ৮ ড্র, হার বাকি ৬টিতে। ব্রাজিল এ সময়ে গোল করেছে ৩৭টি। নেইমার মাঠে থাকতে একসময় শুধু তাঁর-ই ওপর ভরসা করত ব্রাজিল। এখন তাঁর অনুপস্থিতিতে গোল করার কাজটা ভাগ করে নিয়েছেন অন্যরা। এই দুই বছরে ব্রাজিলের হয়ে পাঁচটি করে গোল করেছেন রাফিনিয়া, ভিনিসিয়ুস ও রদ্রিগো। মাঝমাঠে লুকাস পাকেতা ও ব্রুনো গিমারেস তিনটি করে গোল বানিয়েছেন। অর্থাৎ, নেইমারকে ছাড়া একদম অচল হয়ে পড়েনি ব্রাজিলের আক্রমণভাগ।
এ পরিস্থিতিতে ৩৩ বছর বয়সী নেইমার ব্রাজিলের জাতীয় দলে ফিরতে পারবেন কি না—সেই প্রশ্ন থেকেই যায়। কারণ ক্লাব ফুটবলে অন্তত নিয়মিত মাঠে নামলে তাঁকে জাতীয় দলের জন্য বিবেচনা করতে পারতেন আনচেলত্তি। ইতালিয়ান কোচের হাতে সেই সুযোগও নেই। কেন নেই—সেই প্রমাণ দিচ্ছে ‘ও গ্লোবো’র পরিসংখ্যান। সর্বশেষ ৭৩১ দিনের মধ্যে চোটের কারণে ৫২৯ দিনই মাঠের বাইরে নেইমার। অর্থাৎ চোটের কারণে এ সময় ৭২ শতাংশ সময়ই মাঠের বাইরে থাকতে হয়েছে তাঁকে।
উরুগুয়ের বিপক্ষে সেই চোটের পর আর্থ্রোস্কোপিক অস্ত্রোপচারের কারণে প্রায় এক বছর মাঠের বাইরে থাকতে হয় নেইমারকে। তখন তাঁর ফেরা নিয়ে কেউ প্রশ্ন তোলেননি। এসিএল চোট থেকে সেরে উঠতে যে দীর্ঘ সময় লাগে, তা মোটামুটি সবারই জানা। কিন্তু পরের ১২ মাসে নতুন নতুন চোটে বারবার মাঠের বাইরে ছিটকে পড়েছেন নেইমার। গত বছর অক্টোবরে চোট সারিয়ে আল-হিলালে ফেরার পর আরও চারবার চোটে পড়েছেন, মাঠের বাইরে থাকতে হয়েছে ১৬২ দিন।
এরপর নেইমার স্বদেশি ক্লাব সান্তোসে ফিরলেন চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে। তাঁর ফেরার পর থেকে সান্তোস খেলেছে ৩৭ ম্যাচ, নেইমারকে পেয়েছে ২১ ম্যাচে। ৬ গোল করেছেন, করিয়েছেন ৩টি।
গত মে মাসে ব্রাজিল কোচের দায়িত্ব নেন আনচেলত্তি। এ পর্যন্ত তিনবার তিনি জাতীয় দলের স্কোয়াড ঘোষণা করেছেন। এর মধ্যে শুধু একবার নেইমার খেলার মধ্যে থাকলেও আনচেলত্তি তাঁকে দলে ডাকেননি। আনচেলত্তি তখন কারণ হিসেবে নেইমারের পূর্ণ ফিটনেস ফিরে না পাওয়ার কথা বলেছিলেন। কিন্তু নেইমার বলেছিলেন, তাঁর চোট নেই এবং আনচেলত্তির সিদ্ধান্তটি কৌশলগত। পরে আনচেলত্তিও বলেন, ‘এটা ছিল কৌশলগত সিদ্ধান্ত, যা অনেক কিছু ভেবে নিতে হয়েছে।’
প্রশ্ন হলো, আনচেলত্তির এই কৌশলগত সিদ্ধান্তের সঙ্গে কি নেইমারের পূর্ণ ফিটনেস ফিরে না পাওয়ার ব্যাপারটিও জড়িত? ‘ও গ্লোবো’র কলামিস্ট কার্লোস এদুয়ার্দো মানসুর এর ব্যাখ্যা দিয়েছেন, ‘মানুষ অনেক সময় ভুল বোঝে। শারীরিকভাবে সুস্থ, কোনো চিকিৎসা নিতে হচ্ছে না—এই ব্যাপারটির সঙ্গে লোকে পুরো ৯০ মিনিট খেলার মতো ফিট থাকার বিষয়টি গুলিয়ে ফেলে। নেইমার তো আগেই এটা প্রমাণ করেছেন, কিন্তু এই পারফরম্যান্স (ব্রাজিল দলে ফেরায়) তার প্রতিদ্বন্দ্বীদের পেছনে ফেলতে পারেনি। পারফরম্যান্স দিয়ে বোঝাতে পারেননি তিনি শীর্ষ পর্যায়ের ফুটবল খেলতে প্রস্তুত। ব্রাজিলিয়ান চ্যাম্পিয়নশিপে তাঁর পারফরম্যান্স প্রভাব ফেলার মতো নয়।’
ব্যাপারটি আরেকটু ব্যাখ্যার দাবি রাখে। ফুটবলে ‘শারীরিকভাবে ফিট’ কথাটার অন্য একটি অর্থ আছে—কৌশলগতভাবে নিজের খেলা দিয়ে ম্যাচে প্রভাব ফেলা। শারীরিক সুস্থতা এবং কৌশলগতভাবে খেলার দক্ষতা—এ দুটি বিষয় পারস্পরিক সম্পর্কযুক্ত। সহজ কথায়, নেইমারকে শারীরিকভাবে এমন অবস্থায় থাকতে হবে যেন তাঁর মতো খেলোয়াড় ঠিক যেভাবে খেলতে চায়, সেভাবে খেলতে পারে। নেইমারের মতো একজন বল-প্লেয়ার যখন ড্রিবলিংয়ে বারবার ব্যর্থ হন, প্রতিপক্ষের সঙ্গে দৌড়ে পেরে ওঠেন না, বল ছাড়া মুভমেন্টে সতীর্থরা তাঁর ওপর আস্থা রাখতে পারেন না—তখন এই প্রশ্ন তো ওঠাই স্বাভাবিক যে এমন পারফরম্যান্স ব্রাজিল জাতীয় দলের কি উপকারে আসবে?
আনচেলত্তির আক্রমণভাগে এখন দুই উইং থেকে দুজন ভেতরে ঢোকেন। আবার ভেতর থেকে দুজন দুই প্রান্তে ছড়িয়েও যান। কখনো কখনো আবার পজিশনও অদল-বদল করে প্রতিপক্ষের রক্ষণকে ভুল ভাবতে বাধ্য করে এই আক্রমণভাগ। আনচেলত্তি এই ছকে এখনো ভরসা রাখায় নেইমারকে দলে জায়গা করে নিতে হলে উইংয়ে কোথাও খেলতে হবে বলে মনে করেন ব্রাজিলের বিশেষজ্ঞরা। মাঝমাঠে নেইমার যে পজিশনে খেলতে অভ্যস্ত, সেখানে তাঁর মতো অত বড় তারকা না থাকলেও গত কয়েক মাসে কয়েকজনকে তৈরি করে ফেলেছেন আনচেলত্তি।
ব্রাজিলের সাংবাদিক লিওনার্দো মিরান্দার ভাষায়, ‘নেইমার উইঙ্গার হিসেবে খেলেন না অনেক দিন। তিনি মিডফিল্ডার, ১০ নম্বর। এখন তার জায়গায় খেলছেন ভিনি ও ম্যাথিয়াস কুনিয়া। জাতীয় দলে নেইমারের জায়গা নিয়ে সন্দেহ নেই। সমস্যা হলো তাঁর শারীরিক অবস্থা। সান্তোসে এখনো (চোটবিহীন) টানা ম্যাচ খেলতে পারেননি। এ অবস্থায় বিশ্বকাপে তাঁকে নিয়ে ভাবার সুযোগটা নেই। অন্য খেলোয়াড়েরা তাঁর চেয়ে বেশি যোগ্য।’
প্রশ্নটা তাই থেকেই যাচ্ছে, নেইমার ব্রাজিল জাতীয় দলে ফিরতে পারবেন তো? কিংবা একটু ঘুরিয়েও বলা যায়, ২০২৬ বিশ্বকাপে নেইমারকে দেখা যাবে তো?