কোনো দল জোটগতভাবে নির্বাচন করলেও নিজেদের প্রতীকে অংশ নিতে হবে। এমন বিধান যুক্ত করে নির্বাচনসংক্রান্ত আইন গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশের (সংশোধন) অধ্যাদেশের খসড়া অনুমোদন করেছে অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা পরিষদ।
অবশ্য এমন বিধান নিয়ে আপত্তি আছে বিএনপির। অন্যদিকে এমন বিধানে দ্বিমত নেই জামায়াতে ইসলামীর। জোটভুক্ত হলেও দলীয় প্রতীকে নির্বাচনের সিদ্ধান্তটি ইতিবাচক দেখছে জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি)।
নির্বাচনসংক্রান্ত আইন গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশের (আরপিও) অধ্যাদেশের খসড়া গতকাল বৃহস্পতিবার উপদেষ্টা পরিষদ অনুমোদন করে। প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের সভাপতিত্বে ঢাকার তেজগাঁওয়ে তাঁর কার্যালয়ে উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠক হয়। পরে রাজধানীর ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে ব্রিফিংয়ে উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠকের সিদ্ধান্ত জানান আইন উপদেষ্টা অধ্যাপক আসিফ নজরুল ও প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম।
নিবন্ধিত দল জোটভুক্ত হলে জোটের যেকোনো দলের প্রতীক নেওয়ার স্বাধীনতা ছিল। সেটা বাতিল করলে আমরা মানব না।
সালাহউদ্দিন আহমদ, স্থায়ী কমিটির সদস্য, বিএনপি
অনুমোদিত খসড়ায় আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সংজ্ঞায় সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী ও বিমানবাহিনীকেও যুক্ত করা হয়েছে। এর ফলে সশস্ত্র বাহিনীর সদস্যরাও আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় পুলিশের মতো ভোটকেন্দ্রে দায়িত্ব পালন করতে পারবেন। তিন বাহিনীকে নির্বাচনী দায়িত্ব দিতে আলাদা কোনো আদেশের প্রয়োজন হবে না।
এ ছাড়া পলাতক আসামিদের প্রার্থী হওয়ার সুযোগ না রাখা, প্রার্থীদের দেশে-বিদেশে থাকা সম্পদের বিবরণী দেওয়া বাধ্যতামূলক করা, কোনো আসনে একক প্রার্থী থাকলে ‘না’ ভোটের ব্যবস্থা রাখা, ভোট বন্ধে নির্বাচন কমিশনের ক্ষমতা বাড়ানো, ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন (ইভিএম) ব্যবহার সম্পর্কিত বিধান বিলুপ্ত, ৫০ হাজার টাকার বেশি চাঁদা বা অনুদান ব্যাংকে লেনদেনসহ আরও কিছু সংশোধনী রয়েছে অনুমোদিত খসড়ায়।
হলফনামায় বিদেশে সম্পদের উল্লেখ করা, সশস্ত্র বাহিনীকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অন্তর্ভুক্ত করা, আদালত ঘোষিত পলাতক আসামিকে নির্বাচনের অযোগ্য করা, ৫০ হাজার টাকার বেশি চাঁদা বা অনুদান ব্যাংকে লেনদেনে বিষয়ে বিএনপির আপত্তি নেই। এসবে দ্বিমত নেই জামায়াত ইসলামী ও এনসিপিরও।
আগামী ফেব্রুয়ারির প্রথমার্ধে ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন হওয়ার কথা রয়েছে। এ লক্ষ্যে আগামী ডিসেম্বরের প্রথমার্ধে তফসিল ঘোষণা করতে পারে নির্বাচন কমিশন। এর আগে নির্বাচনসংক্রান্ত আইনে বড় রকমের পরিবর্তন আনছে সরকার।
জোটে দলীয় প্রতীকে ভোট, মিশ্র প্রতিক্রিয়া
আইন উপদেষ্টা অধ্যাপক আসিফ নজরুল সাংবাদিকদের বলেন, যদি নির্বাচনী জোট হয়, তাহলেও দলের যে প্রতীক, তা দিয়ে নির্বাচন করতে হবে; যাতে ভোটার স্পষ্ট ধারণা পান প্রার্থী কোন দলের।
আগে জোটগতভাবে নির্বাচন করলে জোটের শরিক দলের প্রতীক যেকোনো দল ব্যবহার করতে পারত।
নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলের জোটগত নির্বাচনের ক্ষেত্রে নিজেদের প্রতীকে নির্বাচন করার বিধান অন্তর্ভুক্তির বিষয়ে আপত্তি আছে বিএনপির। দলটির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমদ গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, ‘কোনো নিবন্ধিত দল জোটভুক্ত হলে জোটের যেকোনো দলের প্রতীক নেওয়ার স্বাধীনতা ছিল আরপিওর ২১ ধারায়। সেটা বাতিল করলে আমরা মানব না। কারণ, আমরা পরামর্শ দিয়েছিলাম জোটভুক্ত হলে আগের যে বিধানটা ছিল, ওইটাই থাকুক।’
এ বিষয়ের ব্যাখ্যা দিয়ে সালাহউদ্দিন আহমদ বলেন, ছোট দলগুলো জোটভুক্ত হয় শরিক বড় দলের প্রতীক নিয়ে নির্বাচন করার সুবিধার জন্য। অথবা নিজস্ব প্রতীকেও করতে পারে। এটা থাকা উচিত। তা না হলে ছোট দলগুলো জোটভুক্ত হবে কেন?
প্রতিটি দলের নিজস্বতা আছে। দলীয় প্রতীক দলের প্রতিনিধিত্ব করে। তাই নিবন্ধিত দলগুলোর নিজস্ব পরিচয়ে যাওয়াই উত্তম।
সৈয়দ আবদুল্লাহ মুহাম্মদ তাহের নায়েবে আমির, জামায়াতে ইসলামী
দলীয় সূত্রে জানা গেছে, জোটগত নির্বাচনের ক্ষেত্রে বিভিন্ন দলের আগ্রহ থাকে বড় দলের প্রতীকের ভোট করার। এতে ভোটে জেতার সম্ভাবনা বেশি থাকে। জোটগতভাবে নির্বাচনে প্রতীকসংক্রান্ত নতুন বিধানে তাদের মধ্যে অসন্তুষ্টি রয়েছে। তারা বলছে, এ ক্ষেত্রে দলগুলোর সিদ্ধান্ত নেওয়ার স্বাধীনতা থাকা দরকার।
তবে নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলের জোটগত নির্বাচনের ক্ষেত্রে নিজ দলের প্রতীকে নির্বাচন করার বিধান অন্তর্ভুক্তিতে দ্বিমত নেই জামায়াতে ইসলামীর। এ বিষয়ে দলটির নায়েবে আমির সৈয়দ আবদুল্লাহ মুহাম্মদ তাহের প্রথম আলোকে বলেন, প্রতিটি দলের একটা নিজস্বতা আছে। দলীয় প্রতীক দলের প্রতিনিধিত্ব করে। তাই নিবন্ধিত দলগুলোর নিজস্ব পরিচয়ে যাওয়াই উত্তম।
আরওপির নতুন সংশোধনীতে যেসব বিষয় এসেছে, সেগুলো ইতিবাচক মনে করেন এনসিপির যুগ্ম আহ্বায়ক জাবেদ রাসিন। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, জোটগত প্রতীকে নির্বাচন করার কারণে দলীয় স্বকীয়তা-নিজস্বতা নষ্ট হয়। ভোটাররাও দ্বিধা-সংকটে ভোগেন। তাই জোটে গেলেও নিজের দলীয় প্রতীকে নির্বাচনের সিদ্ধান্তটি ভালো হয়েছে।
পলাতক আসামি প্রার্থী নয়
অনুমোদিত আরপিওর নানা সংশোধনের কথা তুলে ধরে আইন উপদেষ্টা অধ্যাপক আসিফ নজরুল সাংবাদিকদের বলেন, বিভিন্ন মামলায় পলাতক ব্যক্তিরা নির্বাচন করতে পারবেন না, এটি যুক্ত করা হয়েছে।
পলাতক আসামি বলতে কাকে বোঝানো হয়েছে, এমন প্রশ্নের জবাবে আইন উপদেষ্টা বলেন, ‘পলাতক হচ্ছে, আদালত যখন পলাতক ঘোষণা করেন। আদালত যেদিন আপনাকে আসতে বলছেন, সেদিন যখন আপনি আসছেন না, তারপর পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দিল, আপনি আসছেন না—আদালত আপনাকে পলাতক ঘোষণা করেন। সেটা বিচার চলাকালীন পলাতক হয়।’
পলাতক আসামিকে নির্বাচনের অযোগ্য ঘোষণা করার প্রস্তাবটি ছিল মূলত নির্বাচনব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের। তখন ইসি এই প্রস্তাবের সঙ্গে দ্বিমত জানিয়েছিল। গত মার্চে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনকে লিখিতভাবে ইসি বলেছিল, এমন বিধান অসদুদ্দেশ্যে ব্যবহৃত হতে পারে, এটি নিয়ে রাজনৈতিক ঐকমত্যের প্রয়োজন রয়েছে। পরে অবশ্য ইসিও পলাতক আসামিদের নির্বাচনে অযোগ্য করার বিধান যুক্ত করার প্রস্তাব দেয়।
জোটে গেলেও নিজের দলীয় প্রতীকে নির্বাচনের সিদ্ধান্তটি ভালো হয়েছে।
জাবেদ রাসিন, যুগ্ম আহ্বায়ক, এনসিপি
চলতি মাসে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল আইনে সংশোধনী আনা হয়েছে। সেই সংশোধনী অনুযায়ী মানবতাবিরোধী অপরাধের কোনো মামলায় কারও বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ দাখিল করা হলে সেই ব্যক্তি জাতীয় সংসদ এবং স্থানীয় সরকার নির্বাচনে অংশ নিতে পারবেন না।
গত বছরের জুলাই অভ্যুত্থান চলাকালে হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে চলমান মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় আওয়ামী লীগের (বর্তমানে কার্যক্রম নিষিদ্ধ) অনেক নেতার বিচার চলছে। এ ছাড়া অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর দলটির বহু নেতা আত্মগোপনে চলে গেছেন, যাঁদের মধ্যে সাবেক অনেক মন্ত্রী-এমপিও রয়েছেন। তাঁদের প্রায় সবার বিরুদ্ধে হত্যা, হত্যাচেষ্টা, দুর্নীতিসহ নানা অভিযোগে মামলা হয়েছে।
দেশি-বিদেশি সম্পদের বিবরণী দিতে হবে
প্রার্থীর হলফনামায় দেশ ও বিদেশে থাকা সম্পদের হিসাব দেওয়া বাধ্যতামূলক করার সিদ্ধান্তের কথা জানিয়ে আইন উপদেষ্টা বলেন, যাঁরা নির্বাচন করবেন, তাঁদের অ্যাফিডেভিটের মাধ্যমে দেশি-বিদেশি উৎস থেকে যত আয় ও সম্পত্তি আছে, তার বিবরণ দিতে হবে। প্রধান উপদেষ্টা এই নির্দেশ দিয়েছেন এবং তা অনলাইনে প্রকাশ করা হবে। প্রার্থীদের জামানতের পরিমাণ ২০ হাজার থেকে বাড়িয়ে ৫০ হাজার টাকা করা হয়েছে। আর যাঁরা রাজনৈতিক দলকে দান-অনুদান, চাঁদা যাই হোক ৫০ হাজার টাকার বেশি হলে তা ব্যাংকিং চ্যানেলের মাধ্যমে দিতে হবে।
জেলা নির্বাচনী কার্যালয় জেলার নির্বাচনী কর্মকর্তা ঠিক করবেন। আর যাঁরা নির্বাচনের সময় দায়িত্ব পালন করবেন, তাঁরা পোস্টাল ব্যালটের মাধ্যমে ভোট দিতে পারবেন। যাঁরা প্রবাসী আছেন, তাঁরাও পোস্টাল ব্যালটে ভোট দেবেন। ভোট গণনার সময় গণমাধ্যম থাকতে পারবে।
সংশোধিত আরপিওতে ‘না’ ভোটের বিধান রাখার কথা জানিয়ে আইন উপদেষ্টা বলেন, যে সংসদীয় আসনে একজন প্রার্থী থাকবেন, সেখানে ভোটাররা ‘না’ ভোট দিতে পারবেন। আর কোনো সংসদীয় আসনে অনিয়ম হলে নির্বাচন কমিশন যদি মনে করে তাহলে পুরো আসনের ভোট বন্ধ করতে পারবে।
