প্রতিষ্ঠার ৫৬ বছর পর নির্বাচন কমিশনের (ইসি) নিবন্ধন পাচ্ছে বাংলাদেশ জাতীয় লীগ। তারা তাদের প্রথম নির্বাচনী প্রতীক লাঙ্গল ফিরে পেতে চায়। তাদের নিবন্ধন নিয়ে আপত্তি জানিয়েছে নিবন্ধনের অপেক্ষায় থাকা নতুন রাজনৈতিক দল জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি)। জাতীয় লীগ নিবন্ধন পাচ্ছে দেখে সবার গাত্রদাহ শুরু হয়েছে বলে মন্তব্য করেছেন দলটির চেয়ারম্যান মাহবুবুল আলম।
রাজনৈতিক দল হিসেবে সম্প্রতি এনসিপি ও বাংলাদেশ জাতীয় লীগকে নিবন্ধন দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে নির্বাচন কমিশন। জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের তরুণ নেতৃত্বের উদ্যোগে গঠিত নতুন সংগঠন এনসিপি বর্তমানে প্রায় সবারই চেনা। বিপরীতে সাধারণ মানুষের কাছে অনেকটাই অপরিচিত বাংলাদেশ জাতীয় লীগ। তবে এ দলটি বাংলাদেশ রাষ্ট্রের চেয়েও পুরোনো। দলটি যখন প্রতিষ্ঠিত হয় তখন নিবন্ধনের কোনো নিয়ম ছিল না।
বাংলাদেশ জাতীয় লীগ সূত্র জানায়, পাকিস্তান আমলে ১৯৬৯ সালের ২০ জুলাই পূর্ব পাকিস্তানের সাবেক মুখ্যমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাতা সহসভাপতি আতাউর রহমান খানের নেতৃত্বে জাতীয় লীগ গঠিত হয়। আতাউর ১৯৭০ সালে পাকিস্তান জাতীয় পরিষদ নির্বাচনে ঢাকা-৩ আসন থেকে ভোটে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে পরাজিত হন। তবে স্বাধীন বাংলাদেশে ১৯৭৩ সালের প্রথম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে তিনি জাতীয় লীগের হয়ে ঢাকা-১৯ আসন থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। তার প্রতীক ছিল লাঙ্গল।
আতাউর রহমান খান পরে শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বাধীন বাকশালে যোগ দিয়ে এর কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য হন। শেখ মুজিবের মৃত্যুর পর বাকশাল বিলুপ্তি হলে তিনি জাতীয় লীগ পুনরায় সংগঠিত করেন। ১৯৭৯ সালে দ্বিতীয় সংসদ নির্বাচনে তিনি ঢাকা-২১ আসন থেকে সংসদ সদস্য পদে জয়ী হন। একই নির্বাচনে তার দলের মফিজুল ইসলাম কুমিল্লা থেকে লাঙ্গল প্রতীক নিয়ে নির্বাচিত হয়েছিলেন।
আতাউর রহমান খান ১৯৮৩-৮৪ সালে সাত দলীয় জোটের অন্যতম সদস্য হিসেবে এরশাদ সরকারের সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে আন্দোলন করেন। পরে মত পরিবর্তন করে ওই সরকারের মন্ত্রিসভায় যোগ দেন। তিনি ১৯৮৪ সালের ৩০ মার্চ এরশাদ সরকারের প্রধানমন্ত্রী হন। এ পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন ১৯৮৫ সালের ১ জানুয়ারি পর্যন্ত।
‘বাংলাদেশ জাতীয় লীগের প্রতিষ্ঠাতা (প্রয়াত আতাউর রহমান খান) এরশাদের মন্ত্রিসভায় যোগ দিলে আমেনা বেগম দলের দায়িত্ব নেন। জাতীয় লীগ কোনোদিনই বিলুপ্তি হয়নি। এক ব্যক্তি অন্যদলে যেতেই পারেন, তাই বলে দল কখনো বিলুপ্ত হয় না। আওয়ামী লীগ-বিএনপির অনেক বড় বড় নেতা অন্য দলে গেছেন বা দল পরিবর্তন করেছেন তাই বলে দলগুলো কি বিলুপ্ত হয়েছে?’ —মাহবুবুল আলম, চেয়ারম্যান, বাংলাদেশ জাতীয় লীগ
আতাউর রহমান খান প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর আমেনা বেগম জাতীয় লীগকে পুনর্গঠন করে দলের সভাপতির দায়িত্ব গ্রহণ করেন।
ইসি ও বাংলাদেশ জাতীয় লীগ সূত্রে জানা গেছে, কোনো রাজনৈতিক দলকে ভোটে অংশ নিতে হলে ইসির নিবন্ধন বাধ্যতামূলক। নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে ২০০৮ সালে এ নিবন্ধন প্রথা চালু হয়। এরপর বারবার ইসিতে আবেদন করেও নিবন্ধন পায়নি জাতীয় লীগ। এবার তারা এতে সফল হতে যাচ্ছে।
জাতীয় লীগ নিয়ে আপত্তি এনসিপির
বাংলাদেশে জাতীয় লীগের নিবন্ধন নিয়ে আপত্তি জানিয়েছে এনসিপি। দলটির জহিরুল ইসলাম মুসা বৃহস্পতিবার (৯ অক্টোবর) সাংবাদিকদের জানান, গণমাধ্যমের প্রতিবেদন অনুযায়ী জাতীয় লীগের কেন্দ্রীয় অফিসের অস্তিত্ব নেই, দলের কোনো গঠনতন্ত্র নেই। ওই দলের নেতৃত্বে যারা আছেন, তাদের কেউ চেনে না। মাঠে কোনো কর্মসূচিও নেই।
জহিরুল ইসলাম বলেন, ‘আমরা নির্বাচন কমিশনকে প্রশ্ন করেছিলাম—আপনারা এমন একটি দলকে নিবন্ধন দেওয়ার সিদ্ধান্ত কীভাবে নিলেন?… নির্বাচন কমিশন থেকে আমাদের জানানো হয়েছে, তারা বিষয়টি খুব গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করছেন।’
‘গাত্রদাহ শুরু হয়েছে’
বাংলাদেশ জাতীয় লীগের চেয়ারম্যান মাহবুবুল আলম বলেন, ‘বাংলাদেশ জাতীয় লীগের প্রতিষ্ঠাতা আতাউর রহমান খান এরশাদের মন্ত্রিসভায় যোগ দিলে আমেনা বেগম দলের দায়িত্ব নেন। বাংলাদেশ জাতীয় লীগ কোনো দিনই বিলুপ্তি হয়নি। একজন ব্যক্তি অন্যদলে যেতেই পারেন, তাই বলে দল কখনো বিলুপ্ত হয় না। আওয়ামী লীগ-বিএনপির অনেক বড় বড় নেতা অন্য দলে গেছেন বা দল পরিবর্তন করেছেন তাই বলে দলগুলো কি বিলুপ্ত হয়েছে? এক ব্যক্তি চলে গেলে দল কখনো বিলুপ্ত হয় না। এটা নিয়ে অপপ্রচার চালানো হচ্ছে। দীর্ঘ ৫৬ বছর পর বাংলাদেশ জাতীয় লীগ নিবন্ধন পাচ্ছে দেখে সবার গাত্রদাহ শুরু হয়েছে।’
দলের গঠনতন্ত্র দেখাচ্ছেন না কেন? এমন প্রশ্নের জবাবে মাহবুবুল আলম বলেন, ‘আমরা ইসিতে গঠনতন্ত্র জমা দিয়েছি। গেজেট প্রকাশের আগে এটা দেখালে সমস্যা হবে।’
কে এই আমেনা বেগম
আমেনা বেগম একজন প্রথিতযশা রাজনীতিবিদ। জন্ম ১৯২৫ সালে চাঁদপুরের ফরিদগঞ্জ উপজেলায়। তিনি ১৯৪০ সালে কুমিল্লার নওয়াব ফয়জুন্নেসা গার্লস স্কুল থেকে ম্যাট্রিক এবং ১৯৪২ সালে ঢাকার ইডেন গার্লস কলেজ থেকে আইএ পাস করেন। আমেনা বেগম ১৯৫০ সালে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগে যোগ দেন।
আমেনা বেগম ১৯৫৪ সালে যুক্তফ্রন্ট মনোনীত প্রার্থী হিসেবে কুমিল্লা-সিলেট নির্বাচনী এলাকা থেকে নারীদের জন্য সংরক্ষিত আসনে পূর্ব বাংলা আইন পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন। ১৯৬৬ সালে আওয়ামী লীগের কাউন্সিল অধিবেশনে তিনি কেন্দ্রীয় কমিটির মহিলা সম্পাদক নির্বাচিত হন। ১৯৬৬ সালে ছয় দফা আন্দোলনের সূচনা পর্বে আওয়ামী লীগের সভাপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও সাধারণ সম্পাদক তাজউদ্দিন আহমদসহ শীর্ষস্থানীয় নেতারা গ্রেফতার হলে ওই বছরের ২৭ জুলাই আমেনা বেগমকে দলের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব দেওয়া হয়। তখন আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি আতাউর রহমান খান হন ভারপ্রাপ্ত সভাপতি। সারাদেশে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের ওপর স্বৈরাচারী আইয়ুব সরকারের নির্যাতন-নিপীড়নের ওই সঙ্কটময় সময়ে আমেনা বেগম দলের কার্যক্রম পরিচালনায় বলিষ্ঠ ভূমিকা রাখেন। দলীয় কর্মীদের সঙ্গে সার্বক্ষণিক যোগাযোগ রক্ষা করে ছয় দফা আন্দোলনকে বেগবান করে তোলেন। ১৯৬৮ সালের অক্টোবর মাসে ছাত্রদের ১১ দফা আন্দোলনের সূচনা এবং ১৯৬৯ সালে আইয়ুব বিরোধী গণআন্দোলন সংগঠনেও অসামান্য অবদান ছিলো আমেনার।
আওয়ামী লীগে তার পরবর্তী অবস্থান সম্পর্কে খুবই সচেতন ছিলেন আমেনা বেগম। ১৯৭০ সালে দলের পরবর্তী কাউন্সিল অধিবেশনে তিনি সাধারণ সম্পাদকের পদ দাবি করেন। কিন্তু ইপ্সিত পদলাভে ব্যর্থ হয়ে আওয়ামী লীগ থেকে পদত্যাগ করেন। পরে তিনি আতাউর রহমান খানের নবগঠিত দল জাতীয় লীগে যোগ দেন। ১৯৭০ সালের ২০ আগস্ট তিনি জাতীয় লীগের সিনিয়র সহসভাপতি নির্বাচিত হন।
আমেনা বেগম ১৯৭০ সালে পাকিস্তান জাতীয় পরিষদ নির্বাচনে জাতীয় লীগ মনোনীত প্রার্থী হিসেবে ঢাকা-৯ আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে পরাজিত হন। ১৯৭৬ সালে রাজনৈতিক দলবিধির আওতায় জাতীয় লীগ পুনরুজ্জীবিত হওয়ার পর আমেনা বেগম রাজনীতিতে সক্রিয় হন।
সাত দলীয় শরিক দল জাতীয় লীগের মুখপাত্র হিসেবে তিনি জেনারেল হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের সামরিক শাসনবিরোধী আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেন। ১৯৮৯ সালের ৭ এপ্রিল ঢাকায় শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন আমেনা বেগম।