মঙ্গলবার, সেপ্টেম্বর ১৬, ২০২৫
No menu items!
বাড়িমতামতচেষ্টা অবিরত কিন্তু ব্যর্থতার ঝুড়িটা ভারি

চেষ্টা অবিরত কিন্তু ব্যর্থতার ঝুড়িটা ভারি

আদিলুজ্জামান চৌধুরী

জমির ক্ষেত্রে খতিয়ান অর্থ হলো হিসাব’। মূলত জমির মালিকানা স্বত্ব ও রাজস্ব আদায়ের জন্য জরিপ বিভাগ কর্তৃক প্রতিটি মৌজার জমির এক বা একাধিক মালিকের নাম, পিতা বা স্বামীর নাম, ঠিকানা, দাগ নম্বর, ভূমির পরিমাণ, হিস্যা (অংশ) খাজনা ইত্যাদি বিবরণসহ যে ভূমি স্বত্ব প্রস্তুত করা হয় তাকে খতিয়ান বলে। খতিয়ান মূলত চার প্রকার। সি. এস খতিয়ান, এস এ খতিয়ান, আর. এস খতিয়ান, বি.এস খতিয়ান বা সিটি জরিপ।
ভূমি ক্রয়-বিক্রয়, ভূমির মালিকানা হস্তান্তরের ক্ষেত্রে এবং ভূমি সংক্রান্ত মামলা মোকদ্দমায় এই খতিয়ানের প্রয়োজন হয়। তবে এসব ক্ষেত্রে অবশ্যই খতিয়ানটি হতে হবে ‘সই মুহুরী নকল’। অর্থাৎ সরকারের দায়িত্বরত কর্মচারী ও কর্মকর্তাগণের স্বাক্ষরে স্বাক্ষরিত হতে হবে। তবেই এটি সকল ক্ষেত্রে গ্রহনযোগ্য হবে। এই খতিয়ানের সই মুহুরী নকল জেলা প্রশাসকের কার্যালয় থেকে প্রদান করা হয়ে থাকে।কখনো যদি কারো খতিয়ানের প্রয়োজন হয় তখন নিয়ম হচ্ছে, জেলা প্রশাসকের কার্যালয় থেকে আবেদনের মাধ্যমে খতিয়ানের ‘সই মুহুরী নকল’ সংগ্রহ করা। সাধারণ মানুষ তার প্রয়োজনে খতিয়ানের সই মুহুরী নকল সংগ্রহের জন্য জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে ভিড় জমায় আর এই সুযোগকে একটি চক্র গড়ে তোলে খতিয়ান বাণিজ্য। এ বাণিজ্য আজ নতুন নয়। বহুকাল যাবত বহমান।
কিছু অসাধু কর্মচারী ও একাধিক দালাল চক্র এই বাণিজ্যে সক্রিয়। প্রতি খতিয়ান সংগ্রহ করতে গিয়ে সাধারণ মানুষকে গুণতে হচ্ছে ২০০/- থেকে ৫০০/- টাকা। খতিয়ানের প্রকার ভেদে এই অর্থের অংক কখনো কখনো হাজারের ঘরে গিয়েও ঠেকে। মানুষ অতিব প্রয়োজনে খতিয়ান সংগ্রহের ক্ষেত্রে এই অর্থ বাধ্য হয়েই ব্যায় করে থাকে।
খতিয়ান বানিজ্য রোধ করার পাশাপাশি এই সেবাকে ত্বরান্বিত করতে ডিজিটাল রেকর্ডরুম (ডি আর আর) নির্মানের মাধ্যমে অনলাইন সেবা কাযক্রম চালু করে বর্তমান সরকার। তবে এই সেবা খাত ডিজিটাল হওয়ায় অসাধু কর্মচারীরা একটু দমলেও দালাল চক্র আগের চাইতে আরো বেগবান হয়ে উঠেছে। বাণিজ্যেরও কিছুটা ধরন পরিবর্তন হয়েছে সাথে প্রতারনাও বেড়েছে।
ডিজিটাল হওয়ার আগে একজন লোক রেকর্ড রুমে গিয়ে কর্মচারীদের সাথে কথা বলে ১০০/- টাকা থেকে ২০০/- টাকা ধরিয়ে দিত এবং একদিন কিংবা দুই-তিন দিনের মধ্যে খতিয়ানের সই মুহুরী নকল হাতে পেয়ে যেত। ডিজিটালাইজেশন হওয়ার পর মানুষ খতিয়ানের সই মুহুরী নকলের জন্য প্রথমে অনলাইনে আবেদন করে এবং সাত থেকে দশ দিন পর রেকর্ড রুম থেকে সংগ্রহ করে থাকে। কেউ কেউ আবার ডাকযোগেও সংগ্রহ করে থাকে। কিন্তু ডিজিটাল হওয়ার পর বাণিজ্যের ধরনটা যেভাবে পাল্টে গেল তা দেখে দুর্নিতিকারীদের অপমেধাকে সাধুবাদ না জানালেই নয়। আগে মানুষ ১০০/- টাকা থেকে ২০০/- টাকা দিয়ে যেভাবে খতিয়ানের সই মুহুরী সহজেই সংগ্রহ করতো, ডিজিটাল হওয়ার পর সেটা ৩০০/-থেকে ৫০০/- টাকায় গিয়ে দাড়িয়েছে।
ডিজিটালাইজেশন হওয়ার পর প্রতারনা এখন উর্দ্ধমূখী। উর্দ্ধমূখী হওয়ার পেছেন অনেকগুলো কারণও রয়েছে। অনলাইনে আবেদন করতে গেলে নানা সমস্যার সম্মূখিন হতে হয় মানুষকে। সি.এস, আর.এস, অনেক খতিয়ান ছেড়া বা অস্পষ্ট থাকায় আর্কাইভ করা সম্ভব হয়নি। মৌজার নাম ও মৌজা নম্বর ভুল, আবেদন করার ফলেও খতিয়ান পাওয়া যাচ্ছে না, এমন বেশ কিছু সমস্যার কারণে মানুষ দালাল চক্রের উপর পুরোপুরি নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে। আর এই নির্ভরশীলতাই প্রতারনাকে উর্দ্ধমূখীর দিকে নিয়ে গেছে। বিড়ম্বনাময় অনলাইন সেবার ফলে একটি চক্র জাল খতিয়ানও সরবরাহ করে চলেছে। এতে সরকার যেমন রাজস্ব থেকে বঞ্চিত হচ্ছে তেমনি সাধারণ মানুষ প্রতিনিয়ত প্রতারণার শিকার হচ্ছে।
খতিয়ান বাণিজ্যের এই দূর্নীতি, জালিয়াতি ও প্রতারনা রোধে জেলা প্রশাসকের উর্দ্ধতন কর্মকর্তাদের অবিরাম চেষ্টা বিদ্যমান থাকলেও ফল কিন্তু শুন্য। রেকর্ড রুমের দূর্নীতি রোধে ইতিমধ্যে কুমিল্লা জেলা প্রশাসক খতিয়ান সেবা নিয়ে নতুন নিয়ম চালু করেছে। খতিয়ানের সই মুহুরী নকল ডাকযোগে আবেদনকারীর ঠিকানা মোতাবেক পৌছে দেওয়ার পরিকল্পনা নিয়েছে। এবং এ জন্য সরকারী ফি ৫০ টাকার সাথে ডাকযোগ ফি ৪০ টাকা যুক্ত হয়ে মোট ৯০ টাকা নেয়া হচ্ছে। বর্তমানে অনলাইনে আবেদনের সময় অফিস ডেলিভারী অপশনটি ডিএ্যাকটিভ করে রাখা হয়েছে। পরিকল্পনাটি ভালো কিন্তু সময় মোতাবেক যদি মানুষ তার কাঙ্খিত খতিয়ানের সই মুহুরী নকল না পায় তবে এ পরিকল্পনা পুরোটাই বৃথা।
কুমিল্লা জেলা প্রশাসক বহুবার বহু দালালকে গ্রেপ্তার করে কারাগারেও প্রেরন করেছিল। কিন্তু কয়েকমাস কারাগারে থাকার পর ঐ দালাল আবারো সেই আগের পেশাতেই ফিরে আসছে। রেকর্ড রুমের কর্মচারীদেরকে শাখা বদলীর মাধ্যমে কয়েকদফা রদবদলও করা হয়েছে, করছেও বটে। কিন্তু ফল শুন্য। দালালদের গ্রেপ্তার করে কিংবা কর্মকাচারীদের বদলী বা সাময়িক বরখাস্ত করে খতিয়ান বাণিজ্য দূর্ণীতি রোধ করা সম্ভব নয়। রাজস্ব বৃদ্ধি ও সাধারণ মানুষকে প্রতারনার হাত থেকে রক্ষা করতে, আধুনিকায়নের যুগে এই সেবা নিয়ে নতুন করে ভাবতে হবে। পরিবর্তন আনতে হবে সেবা কার্যক্রমে।

 

Notify of
guest
0 Comments
সবচেয়ে পুরাতন
সবচেয়ে নতুন Most Voted
Inline Feedbacks
View all comments
আরো দেখুন

জনপ্রিয় সংবাদ