জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় শিক্ষার্থী সংসদ (জাকসু) ও হল সংসদ নির্বাচনে ভোট গ্রহণে অব্যবস্থাপনা ছিল। ভোট গণনার ক্ষেত্রেও চরম অব্যবস্থাপনা দেখা গেছে।
ভোট গুনতে দেরি হওয়ার মূল কারণ যন্ত্রের (ওএমআর) বদলে হাতে গণনা। কয়েকটি প্যানেলের দাবির মুখে হাতে ভোট গণনার সিদ্ধান্ত হলেও সে জন্য শুরুতে ভালো প্রস্তুতি ছিল না। হাতে কীভাবে গোনা হবে, সে বিষয়ে প্রশিক্ষণও ছিল না। ভোট গণনা কেন্দ্রে সিসিটিভি (ক্লোজড সার্কিট) ক্যামেরা কম ছিল। ফলে যথেষ্ট সংখ্যক টেবিল বসানো যায়নি। পরে সিসিটিভি ক্যামেরা ও টেবিল বাড়ানো হয়। কোনো কোনো ক্ষেত্রে পোলিং কর্মকর্তা ও এজেন্টরা আসতে দেরি করায় গণনা শুরু করতে দেরি হয়।
নির্বাচন কমিশনের সদস্যদের মধ্যে এবং নির্বাচনে দায়িত্ব পালনকারী শিক্ষকদের সঙ্গে নির্বাচন কমিশনের সমন্বয়হীনতা, সহযোগিতার অভাব ও মতামত উপেক্ষা করার অভিযোগ রয়েছে। গতকাল শুক্রবার রাত সাড়ে আটটার পরে সংবাদ সম্মেলন করে পদত্যাগ করেন নির্বাচন কমিশনের সদস্য অধ্যাপক মাফরুহী সাত্তার। ভোট গ্রহণেরদিন বৃহস্পতিবার বিকেলে তিনজন শিক্ষক দায়িত্ব থেকে সরে যান। এই চার শিক্ষক মূলত বিএনপিপন্থী বলে পরিচিত।
ভোট গ্রহণের নির্ধারিত সময় শেষ হওয়ার ৩২ ঘণ্টা পরও গতকাল রাত সোয়া একটা পর্যন্ত বাকি থাকা একটি হল সংসদের ভোট গণনা চলছিল। ওই হল সংসদের ভোট গণনার পাশাপাশি সন্ধ্যা সাড়ে সাতটার দিকে কেন্দ্রীয় শিক্ষার্থী সংসদের ভোট গণনা শুরু হয়।
এদিকে গতকাল সকালে ভোট গণনা করতে এসে হঠাৎ অসুস্থ হয়ে মারা যান বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও প্রীতিলতা হলের পোলিং কর্মকর্তা জান্নাতুল ফেরদৌস। তাঁর মৃত্যুর জন্য অব্যবস্থাপনাকে দায়ী করেছেন তাঁর সহকর্মীরা।
বিশ্ববিদ্যালয়ের পুরাতন কলাভবনের সামনে গতকাল বিকেলে এক জরুরি সংবাদ সম্মেলনে ইতিহাস বিভাগের অধ্যাপক সুলতানা আক্তার বলেন, মতবিনিময় সভায় জানানো হয়েছিল, যন্ত্রে ভোট গণনা করা হবে। কিন্তু করা হলো ম্যানুয়াল (হাতে গোনা) পদ্ধতিতে। এই পদ্ধতিতে যদি হল পর্যায়ে ভোট গণনা করা হতো, তাহলে ভোটের দিন রাত ১০টার মধ্যে বিভিন্ন হলের ফলাফল দেওয়া যেত। তার বদলে সিনেটে (নির্বাচন কমিশনের অফিস) ভোট গণনার জন্য নিয়ে আসা হয়। তিনি বলেন, হলে ভোট গণনা শেষ করে তাঁরা নির্বাচন কমিশনে নিয়ে এলে রাত ১১টার মধ্যেই ফলাফল দেওয়া যেত। তাহলে সহকর্মীর মৃত্যু দেখতে হতো না।
জাকসু নির্বাচনে মোট ভোটার ১১ হাজার ৭৪৩ জন। নির্বাচন কমিশনের ধারণা, ভোট পড়েছে ৬৭ থেকে ৬৮ শতাংশ। বিশ্ববিদ্যালয়ের ২১টি হলে ভোটকেন্দ্র ছিল। তবে ভোট গণনা করা হয়েছে সিনেট ভবনে, নির্বাচন কমিশনের কার্যালয়ে।
ভোট গ্রহণের নির্ধারিত সময় শেষ হয় গত বৃহস্পতিবার বিকেল পাঁচটায়। তবে দুটি হলের ভোট গ্রহণে দেরি হওয়ায় ভোট গণনা শুরুর সময়ও পিছিয়ে যায়। নির্বাচন শেষ হওয়ার পাঁচ ঘণ্টা পরে রাত ১০টায় শুরু হয় গণনা। প্রথমে হল সংসদের ভোট গণনা শুরু করে নির্বাচন কমিশন। সেই থেকে গতকাল রাত ১০টায় এই প্রতিবেদন লেখা পর্যন্ত ভোট গণনা চলছিল। মাঝে এক ঘণ্টা বিরতি দেওয়া হয়।
বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনেট ভবনের দ্বিতীয় তলার যে কক্ষে ভোট গণনা হচ্ছে, সেটি প্রয়োজনের তুলনায় অনেক ছোট। এর মধ্যেই অনেকটা বদ্ধ পরিবেশে ভোট গণনা করছেন পোলিং কর্মকর্তা হিসেবে দায়িত্ব পালনকারী শিক্ষক ও প্রার্থীর প্রতিনিধি হিসেবে থাকা শিক্ষার্থীরা।
ভোট গণনার শুরুতে বৃহস্পতিবার রাত ১০টার দিকে কক্ষটিতে চারটি টেবিলে ব্যালট বাক্স খোলা হয়। এভাবে একেক টেবিলে একেক হল সংসদের ভোট গণনা করা হয়। পরে ভোট গণণার গতি বাড়াতে মধ্যরাতের দিকে আরও একটি টেবিল যুক্ত করা হয়।
নির্বাচন কমিশন সূত্র বলছে, এর চেয়ে বেশি টেবিল যুক্ত করার সুযোগ ছিল না। কারণ, কমিশন সিসি ক্যামেরার আওতার বাইরে টেবিল বসিয়ে ভোট গণনায় রাজি হয়নি। শুক্রবার সকালে সিসি ক্যামেরা বাড়ানো হয়। দুটি টেবিল যুক্ত করা হয়। সন্ধ্যার পরে আরও দুটি টেবিল বাড়ানো হয়।
বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর ও নির্বাচন কমিশনের সদস্যসচিব এ কে এম রাশিদুল আলম প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমাদের ওএমআর মেশিন দিয়ে ভোট গণনার জন্য প্রস্তুতি ছিল। কিন্তু এটা তো স্বাভাবিক যে ওএমআরের পরিবর্তে ম্যানুয়ালি হিসাব করলে বেশি সময় লাগবে।’
প্রশ্ন উঠেছে, বুধবার রাতে যখন ওএমআর যন্ত্রের পরিবর্তে হাতে ভোট গণনার সিদ্ধান্ত হয়, তখন কেন সিসি ক্যামেরার ব্যবস্থা করা হয়নি।
জাকসুর পদসংখ্যা ২৫, হল সংসদে ১৫। ভোট গণনার কেন্দ্রে একাধিকবার গিয়ে দেখা যায়, পোলিং কর্মকর্তারা একেকটি ব্যালট নিয়ে কোন প্রার্থী কত ভোট পেয়েছেন, তা কাগজে লিখছেন। এভাবে ঘণ্টার পর ঘণ্টা ধরে হিসাব করা হচ্ছে। গণনার কেন্দ্রে সারা রাত ও সারা দিন প্রার্থীদের কর্মী-সমর্থক ও সাধারণ শিক্ষার্থীদের উপস্থিতি দেখা গেছে।
গতকাল রাত সোয়া একটা পর্যন্ত ২১টি হলের মধ্যে একটি হলের (প্রীতিলতা) ভোট গণনা বাকি ছিল। এরই মধ্যে সন্ধ্যা সাড়ে সাতটার দিকে শিক্ষার্থী ও প্রার্থীদের চাপের মুখে কেন্দ্রীয় সংসদের ভোট গণনা শুরু করে নির্বাচন কমিশন। কিন্তু এই গণনা কখন শেষ হবে, আর কখন আনুষ্ঠানিক ফল ঘোষণা হবে, তা নিশ্চিত করে কেউ বলতে পারছিলেন না।
সন্ধ্যা সাড়ে সাতটার দিকে নির্বাচন কমিশনের কার্যালয়ের সামনে এক সংবাদ সম্মেলনে জাকসুর প্রধান নির্বাচন কমিশনার অধ্যাপক মো. মনিরুজ্জামান বলেন, রাতের মধ্যেই জাকসুর কেন্দ্রীয় সংসদ ও ২১টি হল সংসদের ভোট গণনা শেষে নির্বাচনের ফলাফল ঘোষণা করা হবে।
এর আগে বারবার ফলাফল প্রকাশের সময় বদলেছে। নির্বাচন কমিশনের সদস্যসচিব এ কে এম রাশিদুল আলম বৃহস্পতিবার রাতে প্রথমে সাংবাদিকদের বলেন, শুক্রবার দুপুরের মধ্যে ভোট গণনা শেষ হতে পারে। পরে শুক্রবার দুপুরে তিনি আবার জানান, গণনা শেষ হতে শুক্রবার রাত ৮টা থেকে ১০টা বাজতে পারে।
ষড়যন্ত্রের অভিযোগ শিবিরের
ভোট গণনায় দেরির মধ্যে গতকাল বিকেল সোয়া পাঁচটার দিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনেট হলের সামনে সংবাদ সম্মেলন করেন ছাত্রশিবির-সমর্থিত সমন্বিত শিক্ষার্থী জোটের সাধারণ সম্পাদক (জিএস) প্রার্থী মাজহারুল ইসলাম। তিনি নির্বাচন বানচালের অভিযোগ করে বলেন, ‘…সুস্পষ্টভাবে আমরা ষড়যন্ত্রের ইঙ্গিত পাচ্ছি।’ তিনি বলেন, ‘আমরা একটি ফেয়ার নির্বাচন চাই, শিক্ষার্থীরা যাঁকে ইচ্ছা, তাঁকে ভোট দেবেন; কিন্তু আপনারা ফেয়ার নির্বাচন করেন।’
এদিকে ফল স্থগিত করা হলে সাধারণ শিক্ষার্থীদের নিয়ে সব ষড়যন্ত্র প্রতিহত করা হবে বলে ঘোষণা দেন স্বতন্ত্র শিক্ষার্থী সম্মিলন প্যানেলের সহসভাপতি (ভিপি) প্রার্থী আব্দুর রশিদ জিতু। গতকাল সন্ধ্যায় বিশ্ববিদ্যালয়ের পুরাতন প্রশাসনিক ভবনের সামনে সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘আমরা শুনতে পাচ্ছি, একটি স্বার্থান্বেষী মহল নির্বাচনের ফল স্থগিতের চেষ্টা চালাচ্ছে। এমন কোনো কিছু করার চেষ্টা করা হলে আমরা সাধারণ শিক্ষার্থীদের সঙ্গে নিয়ে প্রতিহত করব।’
জাকসুতে এবার পূর্ণ ও আংশিকসহ আটটি প্যানেল হয়েছিল। এর মধ্যে ছাত্রদলের প্যানেল, প্রগতিশীল শিক্ষার্থীদের সম্প্রীতির ঐক্য, ছাত্র ইউনিয়ন ও ছাত্র ফ্রন্টের সংশপ্তক পর্ষদ (২৫ পদে ৫ প্রার্থী), স্বতন্ত্র অঙ্গীকার পরিষদ (৮ প্রার্থী) এবং ছাত্র ফ্রন্টের একাংশের একটি প্যানেল (৩ প্রার্থী) ভোট বর্জন করেছে। কয়েকজন স্বতন্ত্র প্রার্থীও ভোট বর্জন করেছেন।
ভোটে রয়েছে ছাত্রশিবির-সমর্থিত সমন্বিত শিক্ষার্থী জোট, গণতান্ত্রিক ছাত্রসংসদ-সমর্থিত শিক্ষার্থী ঐক্য ফোরাম ও বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সাবেক কেন্দ্রীয় সমন্বয়ক আব্দুর রশিদ জিতুর নেতৃত্বাধীন স্বতন্ত্র শিক্ষার্থী সম্মিলন।
যে অভিযোগ তুলে পদত্যাগ করলেন কমিশনার
ভোট গ্রহণের নির্ধারিত সময় শেষ হওয়ার আধা ঘণ্টা আগে বৃহস্পতিবার নির্বাচনী দায়িত্ব থেকে সরে আসার ঘোষণা দেন অধ্যাপক নজরুল ইসলাম, অধ্যাপক শামীমা সুলতানা ও অধ্যাপক নাহরিন ইসলাম খান। নির্বাচন কমিশনের সদস্য অধ্যাপক মাফরুহী সাত্তার সরে যান গতকাল। বিশ্ববিদ্যালয়ের জাতীয়তাবাদী শিক্ষক ফোরামের সাবেক সহসভাপতি তিনি।
গতকাল রাত পৌনে নয়টায় বিশ্ববিদ্যালয়ের কলা ও মানবিকী অনুষদ ভবনের সামনে এক সংবাদ সম্মেলনে মাফরুহী সাত্তার বলেন, ‘নির্বাচন কমিশনে বিভিন্ন সময়ে দেওয়া আমার মতামত উপেক্ষা করায় আমি দায়িত্ব থেকে পদত্যাগ করেছি।’ তিনি বলেন, ‘নির্বাচন নিয়ে গতকাল (বৃহস্পতিবার) অনেক ধরনের প্রশ্ন উত্থাপিত হয়েছে। আগেও আমরা বিভিন্ন মাধ্যমে বিভিন্ন তথ্য পেয়েছি। আমি সব সময় মনে করেছি, একজন শিক্ষক হিসেবে নির্বাচন কমিশনার হিসেবে নির্বাচন কমিশনে আমার মতামত তুলে ধরে সঠিক পদক্ষেপ নিতে সাহায্য করা।’
‘আপনি বিএনপিপন্থী শিক্ষক আর ছাত্রদল ভোট বর্জন করেছে। এমন পরিস্থিতিতে নির্বাচনী কার্যক্রম চলমান রাখলে রাজনীতিতে আপনি কোণঠাসা হয়ে পড়বেন, এমন চিন্তা থেকে পদত্যাগ করেছেন কি না?’ এমন প্রশ্নের জবাবে মাফরুহী সাত্তার বলেন, ‘প্রথমত, আমি বিএনপি করি না। এটা বাংলাদেশের একটি প্রচলিত ভাষা। আমি বাংলাদেশের একজন স্বাধীন নাগরিক এবং একটি আদর্শে বিশ্বাস করি। সেই আদর্শের সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত রয়েছি। আমাকে যাঁরা চেনেন, আমি কোনো সময় কারও কথা বা আমার পরিবারের কারও কথায় নতিস্বীকার বা কাজ করি না।’
‘নির্বাচন প্রশ্নবিদ্ধ হলো’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু) ও হল সংসদের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় গত মঙ্গলবার। ভোটার ছিল ৪০ হাজারের কাছাকাছি। ভোট পড়েছিল ৭৫ শতাংশ। সেই নির্বাচনের ফলাফল ঘোষণা শুরু হয় ওই দিন রাত দেড়টার দিকে। জাকসুর ফলাফল ঘোষণায় অনেক বেশি সময় লাগছে।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শন বিভাগের অধ্যাপক রায়হান রাইন প্রথম আলোকে বলেন, ‘জাকসু নির্বাচন নিয়ে আমাদের সবার অনেক প্রত্যাশা ছিল। কিন্তু একটি গোছানো নির্বাচনের পরিবর্তে আমরা দেখেছি সমন্বয়হীনতা, চরম অব্যবস্থাপনা, প্রস্তুতির ঘাটতি—সর্বোপরি একটি সুষ্ঠু নির্বাচনের বিষয়ে প্রশাসনের সদিচ্ছার অভাব।’ তিনি বলেন, বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন এ পর্যন্ত যা করেছে, তাতে নির্বাচন প্রশ্নবিদ্ধ হলো