উপকূলীয় জেলায় দুর্গম চ্যানেলে ও দ্বীপ অঞ্চলে অবাধে মৎস্য আহরণের ফলে প্রতি বছর বিপুল পরিমাণ মৎস্য ও জলজ সম্পদ ক্ষতির মুখে পড়ছে। এমনকি বিদেশি ট্রলার ও অনিয়ন্ত্রিত মাছ ধরার কারণে দেশের অর্থনীতি ও সামুদ্রিক জীববৈচিত্র্যও হুমকির মুখে। এ পরিস্থিতি মোকাবিলায় সরকার আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে গভীর সমুদ্রে নজরদারি বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এরই অংশ হিসেবে উন্নতমানের ড্রোন ক্রয় করতে চাইছে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়। এজন্য ‘অ্যাকুয়াগার্ড : উপকূলীয় এলাকায় ড্রোনের মাধ্যমে ‘মৎস্যসম্পদ সংরক্ষণ ও নজরদারি প্রকল্প’ নেওয়া হয়েছে। প্রকল্পটির ব্যয় ধরা হয়েছে এক হাজার ৩৮০ কোটি টাকা। প্রকল্পটি পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ে জমা দিয়েছে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়। পরিকল্পনা বিভাগ এটি পরীক্ষা-নিরীক্ষা করছে বলে জানা গেছে।
হাতে আসা নথি ও সংশ্লিষ্ট একাধিক দায়িত্বশীল সূত্র এসব তথ্য নিশ্চিত করেছে।
হাতে আসা নথি থেকে জানা গেছে, প্রকল্পের আওতায় উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন ড্রোন ব্যবহার করে সমুদ্র সংলগ্ন খুলনা-বাগেরহাট ও সাতক্ষীরা দুর্গম চ্যানেলে উপকূলীয় নদী ও সমুদ্রে রিয়েল-টাইম নজরদারি চালানো হবে। এসব এলাকায় বিষ প্রয়োগের, চায়না দুয়ারি জাল, কারেন্ট জাল, ও চরগেরা জাল ব্যবহার করে অবৈধ মাছ ধরা হয়। যার ফলে মৎস্য প্রজনন ও পরিবেশের ওপর গুরুতর প্রভাব পড়ে। কক্সবাজার, নোয়াখালী চট্টগ্রাম, ভোলা ও বরগুনা উপকূলীয় চর ও দ্বীপে একই ধরনের অবৈধ জালের ব্যবহারের মাধ্যমে গভীর রাতে বা গোপনে মাছ আহরণ অব্যাহত রয়েছে। ড্রোনের মাধ্যমে নজরদারি করলে এসব অবৈধ কার্যক্রম বন্ধ করা সম্ভব হবে বলে সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন। মৎস্য অধিদপ্তর অ্যাকোয়াগার্ড প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করবে। এর আগে ড্রোন বিষয়ে বাংলাদেশ বিমান বাহিনীর সঙ্গে একটা সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষর করেছে মৎস্য ও প্রাণী সম্পদ মন্ত্রণালয়। প্রকল্পটি জাতিসংঘের টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজিএস) অর্জনে বিশেষভাবে সহায়ক হবে।
টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রার সঙ্গে সম্পৃক্ততা : জাতিসংঘ এসডিজি লক্ষ্য-১৪ এর (সমুদ্রের সম্পদ সংরক্ষণ) ছাড়াও লক্ষ্য-১ (দারিদ্র্য বিমোচন) ও লক্ষ্য-২ (ক্ষুধামুক্তি) অর্জনে অবদান রাখবে। কারণ মাছ উৎপাদন বৃদ্ধি পেলে দেশের আমিষের চাহিদা পূরণ হবে। একইসঙ্গে জেলেদের কর্মসংস্থানও বাড়বে। বিশেষজ্ঞদের মতে, প্রকল্পটি বাংলাদেশের উপকূলীয় অঞ্চলে মৎস্যসম্পদ সংরক্ষণ ও অবৈধ মাছ ধরা প্রতিরোধে একটি যুগান্তকারী পদক্ষেপ। ড্রোন প্রযুক্তির মাধ্যমে সাশ্রয়ী, দ্রুত ও কার্যকর নজরদারি সম্ভব হলে উপকূলীয় জেলেদের জীবিকা যেমন সুরক্ষিত হবে। তেমনি দেশের সামুদ্রিক সম্পদও রক্ষা পাবে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য। প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হলে মৎস্য খাতে আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার এক নবদিগন্ত উন্মোচন করবে।
মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, ইতোমধ্যে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয় এবং প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের যৌথ উদ্যোগে একটি পরিকল্পনা চূড়ান্ত করা হয়েছে। উন্নত মানের ক্যামেরা, সেন্সর ও স্যাটেলাইট সংযোগযুক্ত এসব ড্রোন গভীর সমুদ্রেও অনিয়ন্ত্রিত ট্রলার চিহ্নিত করতে সক্ষম হবে। এর মাধ্যমে কেবল বেআইনি বিদেশি জাহাজের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ নয়, বরং স্থানীয় জেলেদের নিরাপত্তাও নিশ্চিত করা যাবে। এ সংক্রান্ত একটি প্রকল্প প্রস্তুত করে অনুমোদনের জন্য পরিকল্পনা কমিশনে পাঠানো হয়েছে। এখন কমিশন পরীক্ষা-নিরীক্ষা করছে। তবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দেশের মৎস্যসম্পদ, পরিবেশ ও জলজপ্রাণীর উন্নয়নের জন্য কোনো ধরনের আমলাতান্ত্রিক জটিলতা সৃষ্টি না করে প্রকল্প অনুমোদন করে দেওয়া উচিত হবে।
কোথায় বাস্তবায়িত হবে : দেশের সমুদ্র সংলগ্ন কক্সবাজার, চট্টগ্রাম, ফেনী, নোয়াখালী, লক্ষ্মীপুর, ভোলা, বরিশাল, পটুয়াখালী, বরগুনা, খুলনাসহ ১৯টি উপকূলীয় জেলায় (৭০টি উপজেলা) প্রতি বছর লাখ লাখ জেলে মাছ ধরায় নিয়োজিত রয়েছে। কিন্তু নজরদারির অবৈধ জাল ব্যবহার, নিষিদ্ধ সময়ে মাছ ধরা ও গভীর সমুদ্রে দেশী ও বিদেশি ট্রলারের সীমা লঙ্ঘন অব্যাহত রয়েছে। প্রকল্পের ফলে সামুদ্রিক সম্পদ, পরিবেশ ও জেলেদের জীবন-জীবিকা মারাত্মক হুমকির মুখে পড়ছে। সরকার প্রতি বছর সমুদ্রে ৫৮ দিন মাছ ধরা নিষিদ্ধ রাখে এবং পাঁচটি ইলিশ অভয়াশ্রমে টানা চার মাস মাছ ধরা বন্ধ রাখে। কিন্তু পর্যাপ্ত তদারকি না থাকায় এসব আইন কার্যকরে সীমাবদ্ধতা রয়েছে। বর্তমানে নৌপথে বা স্পিডবোটে নজরদারি চালাতে সময় ও ব্যয় দুটোই বেশি লাগে। বর্তমানে নৌকাভিত্তিক মনিটরিং ব্যয়বহুল, সময়সাপেক্ষ ও অকার্যকর। ড্রোন প্রযুক্তি এক্ষেত্রে হবে সাশ্রয়ী ও কার্যকর সমাধান। রাতদিন রিয়েল-টাইম মনিটরিংয়ের মাধ্যমে জালের ধরন, ট্রলারের চলাচল ও নিষিদ্ধ এলাকায় নৌযান প্রবেশ সহজেই শনাক্ত করা যাবে। তাই এসব বাস্তবায়ন করতে কেনা হবে দীর্ঘ পাল্লার ৪টি ফোরকে ক্যামেরাসহ (১৫০-১৭৫ কিলোমিটার) এবং স্বল্পপাল্লার ২০টি ড্রোন ফোর-কে ক্যামেরাসহ (২৫-৩০ কিলোমিটার)। প্রতিটি ড্রোনে থাকবে হাই-রেজুলেশন ক্যামেরা, জিপিএস-আরটিকে মডিউল ও ব্যাকআপ ব্যাটারি। এ ছাড়া থাকবে ক্লাউড সার্ভার, মনিটরিং ড্যাশবোর্ড, জিও-ফেন্সিং ও এআই অবজেক্ট ডিটেকশন সফটওয়্যার। এ ছাড়া প্রায় দুই লাখ জেলেকে আধুনিক এফআইডি কার্ড ডাটাবেইজে অন্তর্ভুক্ত করা হবে, যা নজরদারি ও আইন প্রয়োগে সহায়ক হবে। ২৪ জন পরামর্শক ও অপারেটর থাকবে। সরকার ধারাবাহিকভাবে এ উদ্যোগ চালিয়ে যেতে পারলে বাংলাদেশের ব্লু ইকনোমিক বা সামুদ্রিক অর্থনীতি আগামী এক দশকে দেশের প্রবৃদ্ধির প্রধান চালিকা শক্তি হয়ে উঠতে পারে। তবে সমন্বিত নজরদারির অভাবে প্রায় সময় বিদেশি ট্রলার অনিয়ন্ত্রিতভাবে মাছ আহরণ করছে বলে অভিযোগ দীর্ঘদিনের।
উল্লেখ্য, এর আগেও ২০১৪ সালে জাতিসংঘের সমুদ্রসীমা নির্ধারণ ট্রাইব্যুনালের রায় অনুসারে বাংলাদেশ প্রায় ১,১৮,৮১৩ বর্গকিলোমিটার সমুদ্র এলাকা পেয়েছে। এই বিপুল সমুদ্রসীমায় এককভাবে টহল দেওয়া প্রায় অসম্ভব। ফলে বিদেশি ট্রলার ও অনিয়ন্ত্রিত মাছ ধরা রোধে কার্যকর ব্যবস্থা নিতে পারেনি সরকার।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের সাবেক মহাপরিচালক ড. খলিলুর রহমান বলেন, প্রচলিত টহল নৌযান দিয়ে এত বড় এলাকা পর্যবেক্ষণ করা সম্ভব নয়। ড্রোন ব্যবহারের ফলে দ্রুত নজরদারি ও তথ্য সংগ্রহ সম্ভব হবে। উপকূলীয় জেলায় মৎস্য সম্পদ আহরণে শৃঙ্খলা ফিরবে এবং জাতীয় অর্থনীতিতে ইতিবাচক প্রভাব পড়বে।
তিনি আরও বলেন, প্রচলিত টহল নৌযান দিয়ে বিশাল উপকূলীয় নদীতে নজরদারি চালানো সম্ভব নয়। ড্রোন ব্যবহারের ফলে খুব কম সময়ে অনেক দূরবর্তী এলাকায় তথ্য সংগ্রহ করা যাবে। এতে বিদেশি জাহাজও শনাক্তকরণ সহজ হবে। এ উদ্যোগ সঠিকভাবে বাস্তবায়ন করা গেলে দেশের সামুদ্রিক ও উপকূলীয় অর্থনীতিতে নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হবে।
এ বিষয়ে মৎস্য ও প্রাণী সম্পদ মন্ত্রণালয়ের সচিব আবু তাহের মুহাম্মদ জাবের বলেন, ড্রোনের মাধ্যমে শুধু মাছ ধরা নিয়ন্ত্রণই করা হবে না। বরং জেলেদের নিরাপত্তা, জলদস্যু দমন ও প্রাকৃতিক দুর্যোগের সময় তথ্য সংগ্রহেও এটি ব্যবহার করা হবে।
তিনি আরও বলেন, যদি গভীর সমুদ্রের মাছ আহরণ সুষ্ঠুভাবে নিয়ন্ত্রণ করা যায়, তবে কেবল জাতীয় আয়ের প্রবৃদ্ধিই বাড়বে না, বরং উপকূলীয় অঞ্চলে লাখ লাখ জেলের জীবিকাও সুরক্ষিত হবে। সরকারের এ বিনিয়োগকে একটি টেকসই অর্থনৈতিক পদক্ষেপ হিসেবে দেখা হবে। তাছাড়া উদ্যোগ বাংলাদেশকে ব্লু-ইকোনমি বা সামুদ্রিক অর্থনীতির নতুন উচ্চতায় পৌঁছে দিতে সহায়ক হবে।