মিসরের রাজধানী কায়রোতে হামাস নেতাদের নিশানা করে ইসরায়েলি হামলার চক্রান্ত রুখে দেওয়া হয়েছে। কায়রো ইসরায়েলকে সতর্ক করে বলেছে, এ ধরনের যেকোনো হামলার কঠোর জবাব দেওয়া হবে। মিসরের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা মিডল ইস্ট আইকে এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন।
একজন উচ্চপদস্থ নিরাপত্তা কর্মকর্তা বলেছেন, গোয়েন্দা প্রতিবেদন থেকে জানা গেছে, ইসরায়েল বেশ কিছুদিন ধরেই কায়রোতে হামাস নেতাদের হত্যার পরিকল্পনা করছে। মিসর গত দুই বছরে যুদ্ধবিরতির আলোচনার সময় ইসরায়েলের এ ধরনের একটি চেষ্টা ব্যর্থ করে দিয়েছিল।
কাতারের রাজধানী দোহায় গত মঙ্গলবার স্থানীয় সময় বিকেল ৪টার দিকে আবাসিক ভবনে প্রায় ১২টি বিমান হামলা চালায় উগ্রবাদী প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর ইসরায়েল। হামাস নেতৃত্বকে লক্ষ্য করে এই হামলা চালানো হয়, যা পুরো অঞ্চলে নিন্দার ঝড় তুলেছে।
ইসরায়েলের কট্টর ইহুদিবাদী প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর হুমকির পরিপ্রেক্ষিতে মিসরের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা মিডল ইস্ট আইকে এই বিবৃতি দিয়েছেন। নেতানিয়াহু হুমকি দিয়েছিলেন, ইসরায়েল অন্যান্য দেশেও হামাসকে লক্ষ্যবস্তু বানাবে।
মিসরের নিরাপত্তা সূত্র জানিয়েছে, ‘মিসরীয় ভূখণ্ডে হামাস নেতাদের জীবনের ওপর যেকোনো হামলাকে মিসর তার সার্বভৌমত্বের লঙ্ঘন ও ইসরায়েলের পক্ষ থেকে যুদ্ধ ঘোষণার শামিল হিসেবে বিবেচনা করবে। এর বিরুদ্ধে পাল্টা জবাব দিতে আমরা একমুহূর্তও দ্বিধা করব না।’
হামাসের শীর্ষস্থানীয় নেতারা মিসরে বসবাসের বিষয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে কখনো কোনো ঘোষণা দেয়নি। তবে নিরাপত্তা সূত্রটি জানিয়েছে, গাজায় ইসরায়েলের নৃশংস হামলার আগে থেকেই বেশ কয়েকজন নেতা বছরের পর বছর ধরে মিসরে বসবাস করছেন। নিরাপত্তার কারণে তাঁদের পরিচয়, সংখ্যা ও সঠিক অবস্থান প্রকাশ করা হয়নি।
সূত্র মতে, এই অঞ্চলকে অন্তহীন যুদ্ধ ও উত্তেজনার দিকে ঠেলে দেওয়ার পরিবর্তে আলোচনায় ফিরে আসার এবং গাজায় যুদ্ধবিরতির জন্য কাজ করতে মিসরীয় কর্মকর্তারা তাঁদের ইসরায়েলি প্রতিপক্ষের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন।

সূত্রটি উল্লেখ করেছে, গাজায় সম্ভাব্য যুদ্ধবিরতির বিষয়ে তেল আবিবের সিদ্ধান্তহীনতার কারণে বেশ কয়েক মাস ধরে এমনিতে মিসর-ইসরায়েল সম্পর্কে উত্তেজনা রয়েছে।
গাজার ভবিষ্যতের দায়িত্ব মিসরের ওপর চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা বিশেষ করে ফিলিস্তিনিদের উত্তর সিনাইয়ে সরিয়ে দেওয়ার চেষ্টার ব্যাপারে মিসরের কর্মকর্তারা সব সময়ই সতর্ক রয়েছেন।
১৯ আগস্ট মিডল ইস্ট আই প্রতিবেদন করেছিল, সিনাইয়ে ফিলিস্তিনিদের সম্ভাব্য প্রবেশ ঠেকাতে মিসর গাজার সঙ্গে মিসর সীমান্তে প্রায় ৪০ হাজার সেনা মোতায়েন করেছে।
মিডল ইস্ট আই প্রতিবেদনে আরও উল্লেখ করেছিল, ভেঙে পড়া গাজা যুদ্ধবিরতির আলোচনা থেকে কায়রোকে একপাশে সরিয়ে রাখা হয়েছে। কারণ, মিসর আশঙ্কা করছে ছিটমহলটিতে বড় ধরনের ইসরায়েলি হামলার কারণে ফিলিস্তিনি সিনাই সীমান্ত ভেঙে ঢোকার চেষ্টা এবং বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করতে বাধ্য হতে পারে।
দোহার হামলার আগে গত সপ্তাহে একজন ঊর্ধ্বতন গোয়েন্দা কর্মকর্তা বলেছিলেন, গাজায় যুদ্ধবিরতি নিশ্চিত করার আলোচনায় কোনো অগ্রগতি না হওয়ায় মিসর ও ইসরায়েলের মধ্যে যোগাযোগ সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে।
মিসর হামাসকে রক্ষা করছে না
মিসরের একজন ঊর্ধ্বতন সামরিক কর্মকর্তা বলেছেন, দোহার হামলায় মিসরের আকাশসীমা ব্যবহার করেনি ইসরায়েল। তিনি বলেন, ‘দোহার হামলায় জড়িত কোনো ইসরায়েলি বিমান মোটেই মিসরের আকাশসীমা অতিক্রম করেনি।’
সেনাবাহিনীর ওই কর্মকর্তা আরও নিশ্চিত করেছেন, দোহার হামলা সম্পর্কে মিসরের আগে থেকে কোনো ধারণা ছিল না এবং এই অভিযান সম্পর্কে মিসর, ইসরায়েল বা যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে কোনো সমন্বয় ছিল না।
মিসরের কর্মকর্তারা মিডল ইস্ট আইকে বলেন, বর্তমানে ইসরায়েল সীমান্তে সিনাই উপদ্বীপে চীনা বিমান প্রতিরক্ষাব্যবস্থা মোতায়েন রয়েছে, যাতে পূর্বানুমতি ছাড়া বা শনাক্ত না হয়ে কোনো বিমান সীমান্ত অতিক্রম করতে না পারে।
দোহায় হামলার পর নেতানিয়াহু তাঁর ভিডিও ভাষণে হামাসকে যেকোনো জায়গায় নিশানা করার হুমকি দেন।
উগ্রবাদী নেতানিয়াহু বলেন, ‘আমি কাতার ও সন্ত্রাসীদের আশ্রয় দেওয়া সব দেশকে বলছি, হয় তাদের বহিষ্কার করুন অথবা তাদের বিচারের আওতায় আনুন। আপনারা তা না করলে আমরা করব।’
গাজায় গণহত্যার দায় ওঠা ইহুদিবাদী নেতা নেতানিয়াহু হামাসের ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবরের হামলাকে যুক্তরাষ্ট্রে ২০০১ সালের ১১ সেপ্টেম্বরের হামলার সঙ্গে তুলনা করেন। তিনি হামাসের বিরুদ্ধে ইসরায়েলের অভিযানকে ‘সন্ত্রাসবাদের’ বিরুদ্ধে একটি বিশ্বব্যাপী লড়াইয়ের অংশ বলে দাবি ধরেন।
গাজায় গণহত্যা চালানো নেতানিয়াহু যুক্তি দেখান, ‘যুক্তরাষ্ট্র যেভাবে আফগানিস্তানে আল-কায়েদা সন্ত্রাসীদের পেছনে ছুটেছিল এবং পাকিস্তানে ওসামা বিন লাদেনকে হত্যা করেছিল, আমরা ঠিক সেভাবে কাজ করেছি।’
নিরাপত্তার কারণে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন বিশিষ্ট নিরাপত্তা বিশ্লেষক মিডল ইস্ট আইয়ের সঙ্গে কথা বলেছেন। ওই কর্মকর্তা বলেন, তিনি মনে করেন—এই সতর্কবার্তাগুলো মূলত হামাসকে নয়, বরং কায়রো নিজেকে এই অঞ্চলে কীভাবে দেখে, সেটাকেই বেশি বোঝায়।
এই বিশ্লেষক মনে করেন, এই সতর্কতাগুলো হামাসের জন্য ততটা নয়, যতটা কায়রো এই অঞ্চলে নিজের অবস্থানকে কীভাবে দেখে তার সঙ্গে সম্পর্কিত।
এই নিরাপত্তা বিশ্লেষক যুক্তি দেন, মিসর হামাসকে রক্ষা করছে না। এই দেশ দলটিকে সন্দেহের চোখে দেখে এবং মিসরে নিষিদ্ধ মুসলিম ব্রাদারহুডের সঙ্গে হামাসের সম্পর্ক আছে বলে মনে করে।
এই বিশ্লেষক আরও বলেন, মিসর নিজেকে সবচেয়ে কৌশলগত আরব দেশ হিসেবে দেখে এবং তার মাটিতে যেকোনো ইসরায়েলি হামলাকে একধরনের অপমান হিসেবে গণ্য করা হবে। এটি মিসরের মর্যাদা ক্ষুণ্ণ করবে এবং সেই আঞ্চলিক অবস্থানকে বিপন্ন করবে।
ঐতিহাসিকভাবে ইসরায়েল ও ফিলিস্তিনি গোষ্ঠী, বিশেষ করে হামাসের মধ্যে মধ্যস্থতাকারী হিসেবে মিসর কেন্দ্রীয় ভূমিকা পালন করেছে। তবে বিগত কয়েক মাস গাজা যুদ্ধবিরতির আলোচনা থেকে মিসরকে ক্রমবর্ধমানভাবে দূরে সরিয়ে রাখা হয়েছে। কায়রোর ভয়, সিনাই উপদ্বীপে ইসরায়েলি স্থল হামলা মিসরকে এই সংঘাতে টেনে আনতে পারে।
নিরাপত্তা বিশ্লেষক তাঁর ব্যাখ্যায় বলেন, ইসরায়েলকে যদি কায়রোতে নির্বিঘ্নে হত্যাকাণ্ড চালানোর অনুমতি দেওয়া হয়, তবে গাজায় একজন বিশ্বাসযোগ্য মধ্যস্থতাকারী হিসেবে মিসরের কাজ করার গ্রহণযোগ্যতা থাকবে না।
এই বিশ্লেষক আরও বলেন, দেশের শাসকেরা এই ভূমিকার জন্য অনেক বিনিয়োগ করেছে। রাজধানীতে একটি হামলা সেই ভাবমূর্তিকে চুরমার করে দিতে পারে। এই অঞ্চলে দেখিয়ে দেবে, মিসর নিজের উঠানও রক্ষা করতে পারে না।
মিসরই প্রথম আরব দেশ যারা ১৯৭৯ সালে জনগণের বিরোধিতা সত্ত্বেও মার্কিন-মধ্যস্থতায় একটি শান্তি চুক্তি স্বাক্ষর করে ইসরায়েলের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক করেছিল। মিসরীয়রা বেশির ভাগই সম্পর্ক স্বাভাবিকীকরণের ক্ষেত্রে শাসকদের সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করে এসেছে এবং ইসরায়েলকে শত্রু ও ফিলিস্তিনের দখলদার হিসেবে বিবেচনা করে আসছে