শুক্রবার, অক্টোবর ৩, ২০২৫
No menu items!
বাড়িআন্তর্জাতিকট্রাম্পের পরিকল্পনায় কি হামাস রাজি হবে

ট্রাম্পের পরিকল্পনায় কি হামাস রাজি হবে

প্রথম দৃষ্টিতে মনে হতে পারে, প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের ২০ দফা পরিকল্পনা (যা ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহুও সমর্থন করেছেন) গাজার দীর্ঘ দুই বছরের রক্তক্ষয়ী সংঘাত থামানোর জন্য এখন পর্যন্ত যত উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে, তার মধ্যে সবচেয়ে কার্যকর উদ্যোগ।

ট্রাম্প নিজেই বলছেন, তিনি মধ্যপ্রাচ্যের ‘হাজার বছরের’ পুরোনো সমস্যার সমাধান খুঁজছেন, আর সে লক্ষ্যে তিনি প্রচুর রাজনৈতিক ‘মূলধন বিনিয়োগ’ করেছেন। এই পরিকল্পনার পেছনে আঞ্চলিক দেশগুলোর সমর্থনও আছে বলে শোনা যাচ্ছে।

কিন্তু সমস্যা হলো, এটি আসলে কোনো স্পষ্ট ও বিস্তারিত রোডম্যাপ নয়। বরং এটিকে তাড়াহুড়া করে কাগজে টেনে দেওয়া একটা খসড়া বলা যেতে পারে। মানে, এতে গন্তব্যের দিকনির্দেশনা আছে বটে, কিন্তু তা এতটাই অস্পষ্ট ও ঝাপসা যে, যেকোনো মুহূর্তে পুরো পথ হারিয়ে ফেলার ঝুঁকি তৈরি হবে।

সহজভাবে বললে—এই পরিকল্পনা ঠিকঠাক কাজে লাগলে হয়তো সংঘাতের অবসান ঘটাতে পারে, কিন্তু ভেতরে-ভেতরে এতে এত ফাঁকফোকর আছে যে ভুল পথে গেলে নতুন জটিলতাও তৈরি হতে পারে। অর্থাৎ পরিকল্পনাটি যেমন বড় আশা দেখায়, তেমনি সমানভাবে তা ভেস্তে যাওয়ারও আশঙ্কাও বহন করে।

প্রথমত, হামাস এই পরিকল্পনা ভালো চোখে দেখবে, এমন সম্ভাবনা কম। কারণ, এতে বলা হয়েছে হামাসকে সব কিংবা অধিকাংশ অস্ত্র সমর্পণ করতে হবে; আর গাজা পরিচালনা করবে স্বয়ং ট্রাম্পের নেতৃত্ব দেওয়া এক ‘শান্তি পরিষদ’। শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান মেনে নেওয়া হামাস সদস্যদের জন্য সাধারণ ক্ষমার প্রস্তাবও খুব আকর্ষণীয় নয়।

হামাস দাবি করতে পারে, তাদের কারণে সাহায্য পৌঁছাচ্ছে। অর্থাৎ, তারা বলতে পারে, তাদের সক্রিয়তা ও শক্তি না থাকলে আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো গাজায় প্রবেশ বা লজিস্টিক কাজ করতে পারত না। তাই শুধু সাহায্য পাওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে তাদের রাজনৈতিক ও সামরিক অস্তিত্ব ত্যাগ করানো কঠিন।

প্রশ্ন হলো, কাতার বা অন্যরা হামাসকে কি এতটা চাপ দিতে পারবে যে হামাস অনিচ্ছা সত্ত্বেও এই পরিকল্পনায় সাময়িক সম্মতি দেবে? কারণ, হামাস সম্মতি দিলে তা মূলত গাজায় তাদের রাজনৈতিক ও সামরিক শক্তিকে নিশ্চিহ্ন করে দেবে।

আরও প্রশ্ন হলো, হামাস নেতাদের কি বোঝানো সম্ভব হবে যে তাদের হাতে থাকা ৫০ জনের মতো ইসরায়েলি বন্দী আসলে এখন বোঝা হয়ে দাঁড়িয়েছে—কারণ এটিকেই অজুহাত বানিয়ে ইসরায়েল যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছে? গাজার সামরিক কমান্ডাররা কি কাতার বা ইস্তাম্বুলে থাকা রাজনৈতিক নেতাদের সঙ্গে একমত হবেন? এসব প্রশ্নের কোনো নিশ্চিত জবাব নেই।

ট্রাম্প বলছেন, আরব দেশগুলো নাকি গাজাকে নিরস্ত্রীকরণের বিষয়ে রাজি হয়েছে। যদি সত্যি তা–ই হয়, তাহলে এটি অবশ্যই বড় ইতিবাচক পদক্ষেপ। কিন্তু প্রশ্ন হলো, এর মানে আসলে কী? এসব আরব দেশ কি গাজায় সেনা পাঠাবে, শুধু টাকা দেবে নাকি দুটোই করবে?

এখন পর্যন্ত কোনো দেশ সরাসরি বলেইনি যে তারা সেনা পাঠাবে। অথচ কাজটা হবে ভীষণ জটিল ও ঝুঁকিপূর্ণ। সেনা পাঠানো বা পুরো পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে মাসের পর মাস লেগে যাবে আর সেই সময়েই কে কী করবে, তা নিয়ে দেশগুলোর মধ্যে ঝগড়া-বিবাদ শুরু হওয়ার সম্ভাবনা অনেক।

ইসরায়েলের সেনা প্রত্যাহারকে নিরস্ত্রীকরণের গতি ও মাত্রার সঙ্গে যুক্ত করা হয়েছে। এটি ইসরায়েলের জন্য সুবিধাজনক। কারণ যেসব এলাকা তারা ছাড়বে, সেগুলো আগেই তাদের ধ্বংসাত্মক অভিযানে মাটির সঙ্গে মিশে গেছে। ধীরগতির প্রত্যাহার তাদের জন্য ক্ষতির নয়। হয়তো একসময় তারা শুধু সীমানার পাশে গিয়ে অবস্থান করবে, কিন্তু কত দিন লাগবে, সেটি অনিশ্চিত। প্রকাশিত মানচিত্রও অস্পষ্ট। এগুলো হামাসের সাম্প্রতিক আলোচনায় করা দাবির সঙ্গে একেবারেই মেলে না। আর কোনো পর্যায়েই ফিলিস্তিনি রাষ্ট্রের প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়নি।

নেতানিয়াহু ও ট্রাম্প দুজনই জোর দিয়ে বলেছেন, যদি বিষয়গুলো তাদের পরিকল্পনা অনুযায়ী না এগোয়, আর আরব দেশগুলো হামাসকে চাপ দিতে না পারে, তবে মার্কিন সমর্থন নিয়ে ইসরায়েল আবার সামরিক অভিযান শুরু করবে।

চুক্তি কার্যকর হওয়ার ৭২ ঘণ্টার মধ্যে হামাস বন্দীদের মুক্তি দিলেই ইসরায়েল প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করার সুযোগ পেয়ে যাবে। এর আগে মার্চ মাসে ইসরায়েল দুই মাসব্যাপী যুদ্ধবিরতির দ্বিতীয় ধাপে যাওয়ার প্রতিশ্রুতি ভেঙেছিল।

আঞ্চলিক সম্পর্ক স্বাভাবিক করা (অর্থাৎ আরব দেশগুলোর সঙ্গে ইসরায়েলের কূটনৈতিক ও অর্থনৈতিক সম্পর্ক উন্নত করা) এবং আব্রাহাম চুক্তি আরও এগিয়ে নেওয়া একধরনের আকর্ষণীয় লক্ষ্য হতে পারে। কিন্তু গত দুই বছরের অভিজ্ঞতা বলছে, ইসরায়েলের নীতিনির্ধারকেরা (সরকার ও নেতৃত্ব) আসলে এই লক্ষ্যগুলোকে খুব একটা গুরুত্ব দেয় না।

নিজ দেশে বিভাজন বাড়ছে, যুদ্ধবিরোধী মনোভাব ছড়াচ্ছে, আন্তর্জাতিক বিচ্ছিন্নতা ও কূটনৈতিক ব্যর্থতা বাড়ছে—এই প্রেক্ষাপটে নেতানিয়াহু হয়তো হিসাব কষেছেন, যুদ্ধ চালিয়ে গেলে সামান্য লাভ হলেও তার খরচ অনেক বেশি। তাই তাঁর জন্য এখনই ‘বিজয় ঘোষণা’র সময়।

এখন নেতানিয়াহু নতুন এক প্রচারণা শুরু করছেন। পুরো সংঘাতকালেই দুর্নীতির অভিযোগে কারাদণ্ডের হুমকির মুখে থাকা নেতানিয়াহু নিজের রাজনৈতিক ক্ষমতা আঁকড়ে রাখাকেই মূল লক্ষ্য করেছেন। এবার মনে হচ্ছে তিনি ভাবছেন, তাঁর জোটের অতি ডানপন্থী সদস্যরা সরকার ছাড়লেও তিনি টিকে থাকবেন। হয়তো তিনি তাঁদের হুমকিকে পাত্তা দেবেন না বা নেসেটে (পার্লামেন্ট) সংখ্যাগরিষ্ঠতা ধরে রাখবেন। তাঁর ধারণা, এক বছরের মধ্যে অনুষ্ঠেয় নির্বাচনে তিনি জিততেও পারেন।

ট্রাম্প যে পরিকল্পনা টেনেছেন, তাতে হামাস ছাড়া বাকিরা সম্মতি দিয়েছে—এটা বড় কথা। তবে সত্যিকারের কাজ এখন শুরু। হামাসকে রাজি করে নেওয়া গেলেও অনেক ছোট-বড় বিষয় পরিষ্কার করতে হবে, সবকিছু লিখে চুক্তিতে আনতে হবে এবং তারপর তা বাস্তব করতে হবে। এগুলো করতে সময় লাগবে এবং তা সহজও না। তাই সফল হওয়া বা স্থায়ী শান্তি পাওয়া এখনো অনিশ্চিত।

Notify of
guest
0 Comments
সবচেয়ে পুরাতন
সবচেয়ে নতুন Most Voted
Inline Feedbacks
View all comments
আরো দেখুন

জনপ্রিয় সংবাদ