বিশ্বের অন্যতম মর্যাদাপূর্ণ চলচ্চিত্র উৎসব কান চলচ্চিত্র উৎসবের সর্বোচ্চ সম্মান ‘পাম দ’অর’ জয় করলেন ইরানের সাহসী চলচ্চিত্র নির্মাতা জাফর পানাহি। তার নতুন ছবি ‘এটা কেবলই এক দুর্ঘটনা’ (It Was Just an Accident) পুরস্কার পাওয়ার পাশাপাশি সমালোচক মহলেও আলোড়ন তুলেছে। তবে সিনেমাটির পেছনের গল্প তার চেয়েও বেশি বিস্ময়কর।
পানাহি এমন এক দেশে বসবাস করেন, যেখানে রাষ্ট্রের সমালোচনা করলেই কারাগার অনিবার্য। ২০০৯ সালের নির্বাচনে কারচুপি নিয়ে প্রতিবাদী একটি চলচ্চিত্র নির্মাণের পরিকল্পনার জন্য তাকে ছয় বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয় এবং ২০ বছরের জন্য চলচ্চিত্র নির্মাণ ও দেশ ত্যাগে নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়। কিন্তু তিনি হার মানেননি।
কারাগারের ভেতর থেকেই সিনেমার জন্ম দিয়েছেন। জাফর পানাহি বলেন, ‘যদি আমি কারাগারে না যেতাম, হয়তো এই চলচ্চিত্র কখনোই তৈরি হতো না। আসলে এই চলচ্চিত্র আমি নয়, যারা আমাকে বন্দি করেছে, তারাই তৈরি করেছে।’
ছবির গল্প এক প্রাক্তন বন্দিকে ঘিরে। সে বিশ্বাস করে তার নির্যাতনকারী গোয়েন্দা কর্মকর্তাকে চিনে ফেলেছে। যদিও কারাগারে কখনো সেই কর্মকর্তার মুখ দেখেনি, কিন্তু তার কৃত্রিম পায়ের শব্দ মনে গেঁথে আছে। এরপর শুরু হয় প্রতিশোধ, সন্দেহ ও ন্যায়বিচারের এক জটিল যাত্রা।
পানাহির মতে, এই চলচ্চিত্র প্রতিশোধ ও ন্যায়বিচারের সীমারেখা নিয়ে এক মানবিক প্রশ্ন তোলে। ‘এই ছবির আসল বিষয় প্রতিশোধ নয় বরং ক্ষমা, ন্যায়বিচার ও সহিংসতার চক্র ভাঙা’- দাবি পরিচালকের।
রাষ্ট্রের কঠোর নজরদারি এড়িয়ে তিনি ছোট দল নিয়ে, ন্যূনতম সরঞ্জাম ব্যবহার করে গোপনে শুটিং করেছিলেন। অনুমতি ছাড়াই চিত্রায়িত হয় পুরো সিনেমা। অভিনেতাদের নামও নিরাপত্তার কারণে গোপন রাখা হয় তখন। জাফর পানাহি বলেন, ‘আমাদের দেশে সিনেমা বানানো মানেই ঝুঁকি নেওয়া। কিন্তু আমি তো অন্য কিছু জানি না। আমার কথা বলার ভাষা হলো সিনেমা।’
২০২২ সালে ‘নারী, জীবন, স্বাধীনতা’ আন্দোলনের সময় তিনি ফের কারাগারে যান। তখন সহকর্মী পরিচালক মোহাম্মদ রাসুলফকেও আটক করা হয়। সেই সময়কার অভিজ্ঞতাই তার নতুন ছবির অনুপ্রেরণা। তিনি বলেন, ‘যখন আমি জেল থেকে বের হলাম, বুঝলাম আমার সহবন্দিরা এখনো ভেতরে আছে। আমি কিছু করতে চাইলাম। আর সেটা হলো এই সিনেমাটি।’
এই চলচ্চিত্রে নারী চরিত্রদের মাথায় বাধ্যতামূলক ওড়না নেই। যা আগে ছিল আইনবিরুদ্ধ। কিন্তু পানাহির মতে, ‘সামাজিক বাস্তবতাকে আড়াল করা মানে মিথ্যা বলা। সমাজ যেমন, সিনেমাতেও তা তেমনই হতে হবে।’
তিনি বিশ্বাস করেন, ইরানে বর্তমান শাসনব্যবস্থা চিরস্থায়ী নয়। তার মতে, ‘এই চলচ্চিত্র আসলে ইরানের পরবর্তী সময়ের জন্য তৈরি। প্রশ্ন হচ্ছে শাসনব্যবস্থা ভেঙে পড়ার পর আমরা কীভাবে ন্যায়বিচার করব?’
আমেরিকা ও পশ্চিমা দেশগুলোতেও তিনি বার্তা দিয়েছেন। তিনি মনে করেন, আজ ইরানে যা ঘটছে, তা হয়তো আগামী দিনে বিশ্বের আরও অনেক দেশে ঘটবে। এখনই সাবধান হওয়ার সময়।
জাফর পানাহির আগের চলচ্চিত্রগুলোর মধ্যে ‘দ্য সার্কেল’, ‘অফসাইড’, ‘দিস ইজ নট আ ফিল্ম’ ও ‘ট্যাক্সি’ আন্তর্জাতিকভাবে প্রশংসিত হয়। এবার ‘এটা কেবলই এক দুর্ঘটনা’ তাকে কেবল শিল্পী নয়, এক প্রতিবাদী কণ্ঠ হিসেবেও ইতিহাসে অমর করে রাখল।