সার্বিকভাবে দেশের রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা কাটছে না। বিভিন্ন অঞ্চলে সৃষ্টি হচ্ছে রাজনৈতিক ও সামাজিক অস্থিরতা। গ্যাস ও বিদ্যুৎ সংকটের পাশাপাশি দীর্ঘ মেয়াদে এর নিরবচ্ছিন্ন সরবরাহ নিশ্চিত করতে নেওয়া হচ্ছে না কোনো স্বল্প বা মধ্যমেয়াদি পরিকল্পনা। তারল্য সংকটে এখনো আক্রান্ত ব্যাংক; উদ্যোক্তাদের চাহিদা অনুযায়ী দিতে পারছে না ঋণের জোগান। মূল্যস্ফীতির ঊর্ধ্বগতি নিয়ন্ত্রণে চলতি অর্থবছরসহ চার অর্থবছর ধরে সংকোচনমুখী মুদ্রানীতি অনুসরণের মাধ্যমে সুদের হার বাড়ানো হয়েছে। দীর্ঘ সময় ধরে টাকার প্রবাহ কমানো এবং সুদের হার বাড়ানোর নীতি গ্রহণের পরও মূল্যস্ফীতির হার প্রত্যাশিত পর্যায়ে নামেনি। ফলে সুদের হারও কমছে না। এসব নিয়ে উদ্যোক্তাদের মধ্যে একধরনের অনিশ্চয়তা ও আস্থাহীনতা বিরাজ করছে। যে কারণে তারা হাত গুটিয়ে বসে আছেন। নতুন শিল্পকারখানা স্থাপনে হাত দিচ্ছেন না। ফলে প্রবৃদ্ধির হারেও লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত হচ্ছে না। অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের এসব বাধা কবে নাগাদ দূর হবে, এরও কোনো নিশ্চয়তা নেই। সবমিলিয়ে দেশের অর্থনীতি এখন কঠিন সময়ের মুখোমুখি।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গত জানুয়ারি-মার্চ প্রান্তিকে বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই স্থিতিশীল ছিল। প্রধান উদীয়মান বাজার এবং ইউরো অঞ্চলে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড শক্তিশালী রয়েছে। শিল্পোৎপাদন ও আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের পাশাপাশি অভ্যন্তরীণ বাণিজ্য বেড়েছে। বিশ্বব্যাপী মূল্যস্ফীতি নিম্নমুখী এবং প্রধান পণ্যের মূল্য হ্রাস পাচ্ছে। তারপরও বৈশ্বিক শুল্কব্যবস্থা নিয়ে সাম্প্রতিক সময়ে সৃষ্ট অস্থিরতা বৈশ্বিক উৎপাদনের জন্য সম্ভাব্য ঝুঁকি তৈরি করেছে।
আলোচ্য প্রান্তিকে দেশীয় অর্থনীতি উল্লেখযোগ্যভাবে প্রতিকূলতার মুখোমুখি হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে নিম্নমুখী প্রবৃদ্ধি, মূল্যস্ফীতির হার লক্ষ্যমাত্রার মধ্যে না আসা এবং দেশের দুর্বল মুদ্রা। ফলে ব্যাংকগুলোর সম্পদের মান কমে যাচ্ছে। জিডিপিতে শিল্প খাতের অবদান হ্রাস পাচ্ছে।
প্রতিবেদন থেকে পাওয়া তথ্যে দেখা যায়, ২০২৩-২৪ অর্থবছরে বড় শিল্পে উৎপাদন বেড়েছিল ৪ দশমিক ২০ শতাংশ। গত অর্থবছরে এ খাতের উৎপাদন বেড়েছে ৫ দশমিক ৩২ শতাংশ। কুটির, ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পে উৎপাদন বেড়েছে ৫ দশমিক ১৮ শতাংশ। জিডিপিতে শিল্প খাতের অবদান হ্রাস পাচ্ছে। গত অর্থবছরে শিল্প খাতের অবদান ছিল ৩৪ দশমিক ৮১ শতাংশ। এর আগের ২০২৩-২৪ অর্থবছরে ছিল ৩৫ দশমিক ২৭ শতাংশ। তবে সেবা খাতের অবদান বাড়ছে। পরিবেশ, প্রাকৃতিক দুর্যোগ-এসব কারণে কৃষিতে প্রবৃদ্ধি নানাভাবে বাধাগ্রস্ত হচ্ছে, টেকসই হচ্ছে না।
সংশ্লিষ্টরা বলেছেন, সেবা খাতের চেয়ে উৎপাদন খাতের বিকাশ কম হলে সরবরাহ ব্যবস্থায় ব্যাঘাত ঘটবে। তখন আবার মূল্যস্ফীতি ঊর্ধ্বমুখী হতে পারে। পাশাপাশি অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় নতুন হুমকি আসতে পারে। এ ধরনের সম্ভাব্য ঝুঁকি এড়াতে উৎপাদন খাতের বিকাশ বাড়াতে হবে সবার আগে। সেবা খাতে ঝুঁকি কম, মুনাফা বেশি। যে কারণে উদ্যোক্তারা সেবামুখী হচ্ছেন। পাশাপাশি উৎপাদন খাতে ঝুঁকি বেশি, মুনাফা কম। তবে উৎপাদন খাতের প্রবৃদ্ধি বেশি হলে অর্থনৈতিক স্থায়িত্ব টেকসই হয়।
এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) সাবেক মহাপরিচালক ও বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. মোস্তফা কে মুজেরী বলেন, অর্থনীতির বড় সংকট দুটি-রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা ও অস্থিরতা এবং সরকারের দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার অভাব। বিনিয়োগকারীদের একটি বার্তা দিতে হবে-সরকার অর্থনীতিকে কত সময়ের মধ্যে কোন জায়গায় নিয়ে যেতে চায়। এক্ষেত্রে সমস্যাগুলো কী, তা চিহ্নিত করতে হবে। সেগুলোর সমাধানের একটি সুনির্দিষ্ট রোডম্যাপ দিতে হবে। তাহলে বিনিয়োগকারীরা বুঝতে পারবেন কী করতে হবে। সে অনুযায়ী তারা বিনিয়োগ পরিকল্পনা করবেন। তিনি আরও বলেন, সাড়ে ৩ বছর ধরে শিল্পে গ্যাস ও বিদ্যুতের সংকট চলছে। এটি কবে সমাধান হবে, কেউ বলতে পারছেন না। সরকারও কোনো সুনির্দিষ্ট দিকনির্দেশনা দিচ্ছে না। ঋণের সুদহারের বিষয়ে একটি রোডম্যাপ থাকা দরকার। কিন্তু তা নেই। ব্যাংকগুলোর সংকট কবে নাগাদ দূর হবে, সেটিও পরিষ্কার করে বলা দরকার। অন্তর্বর্তী সরকার এক বছরের বেশি সময় কাজ করছে, এসব সমস্যা এক বছরের মধ্যেই সমাধান করা যেত। কারণ, এখন ডলার সংকট নেই। গ্যাস ও বিদ্যুৎ আমদানির সুযোগ আছে। আন্তর্জাতিক বাজারে দামও কমেছে। ব্যাংকগুলোকে সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা নিয়ে দ্রুত সচল করা যেত; কিন্তু সরকার সিদ্ধান্ত নিতেই দেরি করে ফেলছে। যে কারণে অস্থিরতা ও অনিশ্চয়তা বাড়ছে। আগামী দিনে নির্বাচিত সরকার ক্ষমতায় এলে অগ্রাধিকার দিয়ে এসব সমস্যার দ্রুত সমাধান করতে হবে। অর্থনীতির একটি দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা করে বেসরকারি খাতকে সহায়তা করতে হবে।
বাংলাদেশ নিটওয়্যার প্রস্তুতকারক ও রপ্তানিকারক সমিতির (বিকেএমইএ) সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম বলেন, করোনা ও বৈশ্বিক মন্দার প্রভাব থেকে অর্থনীতি পুনরুদ্ধারের ক্ষেত্রে বর্তমান সরকার তিন খাতে সফল হয়েছে। এগুলো হচ্ছে-আর্থিক খাতে লুটপাট বন্ধ করেছে, ফলে ব্যাংকগুলো ঘুরে দাঁড়াচ্ছে; ডলার সংকট নিরসন করেছে এবং মূল্যস্ফীতির হার নিম্নমুখী করেছে। এর সুফল পড়ছে দেশের ব্যবসা-বাণিজ্যে। শিল্প খাতে বিনিয়োগ হচ্ছে না। ব্যাংক থেকে ঋণ বিতরণের ক্ষেত্রে কড়াকড়ি আরোপ করা হয়েছে। ফলে চাহিদা অনুযায়ী ঋণও পাওয়া যাচ্ছে না। কেন্দ্রীয় ব্যাংক চাচ্ছে দেশের উদ্যোক্তাদের বিশ্বের মতো ফেয়ার প্র্যাকটিসে নিয়ে আসতে। কিন্তু সেটির জন্য দেশের উদ্যোক্তা ও ব্যাংকাররা প্রস্তুত নয়। এটি একটি সমস্যা। রাতারাতি এগুলো সমাধান করা যাবে না। সময় নিয়ে করতে হবে। এছাড়া ঋণের সুদহার ১৫ থেকে ১৭ শতাংশ। এত সুদ দিয়ে ব্যবসা চালানো কঠিন। রপ্তানির ক্ষেত্রে রপ্তানি উন্নয়ন তহবিলের ঋণ সীমিত করে ফেলা হয়েছে। অথচ এটি রপ্তানিকারকদের জন্য খুব সহায়ক একটি তহবিল ছিল। কম সুদের ঋণও সীমিত করে ফেলা হয়েছে। প্রণোদনা কমিয়ে দেওয়া হয়েছে। গ্যাস-বিদ্যুতের সংকট তো আছে। এসব কারণে উদ্যোক্তারা বিনিয়োগমুখী হচ্ছেন না। বিনিয়োগ না বাড়লে অর্থনীতি পুনরুদ্ধার হবে না।
গত এবং চলতি বছরেও প্রতিকূল পরিবেশের কারণে কৃষি উৎপাদন অঞ্চলভেদে বাধাগ্রস্ত হয়েছে। তারপরও উৎপাদন সামান্য বেড়েছে। তবে কৃষি খাতে ঋণপ্রবাহ কমে গেছে। ২০২৩-২৪ অর্থবছরে কৃষি খাতে ঋণপ্রবাহ বেড়েছিল প্রায় ১৭ শতাংশ। গত অর্থবছরে বেড়েছে মাত্র সাড়ে ৪ শতাংশ। তবে গত বছরের জুলাইয়ের তুলনায় চলতি বছরের জুলাইয়ে ঋণপ্রবাহ বেশ বেড়েছে। গত বছরের জুলাইয়ে ঋণপ্রবাহ নেতিবাচক ছিল ৮ শতাংশ। গত জুলাইয়ে তা ২৪ শতাংশ বেড়েছে। গ্রামের অপ্রাতিষ্ঠানিক শিল্পে ২০২৩-২৪ অর্থবছরে ঋণপ্রবাহ কমেছিল ৩ দশমিক ২৪ শতাংশ। গত অর্থবছরে কমেছে ২২ শতাংশ। গত বছরের জুলাইয়ে কমেছিল প্রায় সাড়ে ২১ শতাংশ। গত জুলাইয়ে কমেছে সাড়ে ৩ শতাংশ। কুটির, ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পে গত বছরের জানুয়ারি-মার্চের তুলনায় চলতি বছরের একই সময়ে ঋণ বিতরণ কমেছে প্রায় ১০ শতাংশ। বড় শিল্পে মেয়াদি ঋণের জোগান বেড়েছে প্রায় ৯ শতাংশ। এর বড় অংশই নবায়ন করা ঋণের সুদ যোগ হয়ে প্রবৃদ্ধি বাড়িয়েছে।
ঋণের সুদহার এখনো ঊর্ধ্বমুখী। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের হিসাবে ২০২৩ সালের জুনে ঋণের সুদহার ছিল ৬ দশমিক ৯৯ শতাংশ। ২০২৪ সালের জুনে তা ছিল ১১ দশমিক ৮০ শতাংশ। গত জুনে তা আরও বেড়ে দাঁড়ায় ১২ দশমিক ৪৪ শতাংশে। জুলাইয়ে আরও বেড়ে হয় ১২ দশমিক ৫২ শতাংশ। শিল্প ও বাণিজ্যে এখন সুদ আরও বেশি-১৩ থেকে ১৮ শতাংশ। সুদের হার বাড়ার কারণে খরচ বেড়েছে। পাশাপাশি ডলারের দাম বাড়ায়ও উৎপাদন খরচ বেড়েছে। এসব কারণে উৎপাদন ব্যয় বেড়েছে। কিন্তু ভোক্তার আয় বাড়েনি। গত আগস্টেও মূল্যস্ফীতির হারের চেয়ে মজুরি বৃদ্ধির হার কম। ২০২২ সালের এপ্রিল থেকে এ অবস্থা চলে আসছে। গত আগস্টে মূল্যস্ফীতি ছিল ৮ দশমিক ২৯ শতাংশ। এর বিপরীতে ভোক্তার আয় বেড়েছে ৮ দশমিক ১৫ শতাংশ। তবে মূল্যস্ফীতির হার কমায় মজুরি বৃদ্ধির সঙ্গে এর ব্যবধান কমেছে।
গত জুলাইয়ে মুদ্রানীতি ঘোষণার সময় কেন্দ্রীয় ব্যাংক বলেছিল সেপ্টেম্বরের মধ্যে মূল্যস্ফীতি ৬ শতাংশের মধ্যে নেমে এলে নীতি সুদের হার কমানোর মাধ্যমে ঋণের সুদহার কমানোর পদক্ষেপ নেওয়া হবে। কিন্তু মূল্যস্ফীতি প্রত্যাশিত হারে সেপ্টেম্বরে কমছে না। ফলে সুদের হারও অপরিবর্তিত রাখা হচ্ছে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের হালনাগাদ প্রতিবেদন থেকে দেখা যায়, চলতি অর্থবছরের জুলাই-আগস্টে রপ্তানি খাতের কাঁচামাল আমদানির এলসি খোলা কমেছে ১১ দশমিক ১১ শতাংশ। তবে আমদানি বেড়েছে ৬ দশমিক ৭০ শতাংশ। গত অর্থবছরের বকেয়া এলসি থেকে আমদানি বাড়ছে। আলোচ্য সময়ে শিল্পের যন্ত্রপাতি আমদানির এলসি খোলা বেড়েছে মাত্র দশমিক ৭২ শতাংশ, আমদানি কমেছে ১১ দশমিক ৮৭ শতাংশ। কাঁচামাল আমদানির এলসি খোলা বেড়েছে ৩ দশামিক ৭২ শতাংশ, আমদানি বেড়েছে ২ দশমিক ৯৮ শতাংশ। শিল্পের মধ্যবর্তী কাঁচামালের এলসি কমেছে ১১ দশমিক ৬২ শতাংশ এবং আমদানি কমেছে ৯ দশমিক ৭২ শতাংশ। শিল্প উপকরণের আমদানির হার এ খাতের বিকাশের জন্য সহায়ক নয়।
বেসরকারি খাতের ঋণপ্রবাহের লক্ষ্যমাত্রাও অর্জিত হচ্ছে না। গত অর্থবছরে বেসরকারি খাতে ঋণপ্রবাহ বাড়ানোর লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৯ দশমিক ৮ শতাংশ। অর্জিত হয়েছে ৬ দশমিক ৪৯ শতাংশ। চলতি অর্থবছরের ডিসেম্বর পর্যন্ত লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৭ দশমিক ২০ শতাংশ। এর মধ্যে অর্থবছরের প্রথম মাসেই নেতিবাচক হয়েছে দশমিক ২৯ শতাংশ। আগামী জুন পর্যন্ত লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৮ শতাংশ। সে লক্ষ্যমাত্রা অর্জন নিয়েও সংশয় রয়েছে।
এদিকে দেশের রাজনীতিতে এখন অনিশ্চয়তা বিদ্যমান। আঞ্চলিক ও সামাজিকভাবে বিভিন্ন ইস্যুতে বিভিন্ন স্থানে অস্থিরতা লেগেই আছে। এতে বিনিয়োগ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। এগুলো কবে নাগাদ কেটে যাবে, এরও কোনো সুনির্দিষ্ট তথ্য নেই। রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা ও সরকার পরিবর্তনের ফলে পরিস্থিতি এখনো স্বাভাবিক হয়নি। চাঙা হচ্ছে না ব্যবসা-বাণিজ্যও। এখন উদ্যোক্তারা বেঁচে থাকার সংগ্রামে লিপ্ত।
ব্যাংকগুলোর তারল্য সংকট ও বর্তমান প্রেক্ষাপটে ঋণ বিতরণে কড়াকড়ি আরোপ করা হয়েছে। এছাড়া রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পর অনেকে পালিয়ে গেছেন বা জেলে আটক রয়েছেন। ফলে তাদের কারখানাগুলোয়ও সংকট রয়েছে। গ্যাসের সংকটের কারণে অনেকে কারখানা স্থাপন করেও চালু করতে পারছেন না। এসব সংকট দূর করার ব্যাপারে সরকার থেকে কোনো প্রতিশ্রুতিও দেওয়া হচ্ছে না।