সরকার দেশের পোলট্রি খাত নিয়ন্ত্রণ করা করপোরেট সিন্ডিকেট না ভাঙলে ১ নভেম্বর থেকে ডিম-মুরগি উৎপাদন স্থগিত করার হুমকি দিয়েছে প্রান্তিক খামারিদের সংগঠন বাংলাদেশ পোলট্রি অ্যাসোসিয়েশন (বিপিএ)।
শনিবার (১৮ অক্টোবর) রাজধানীর ইকোনমিক রিপোর্টার্স ফোরাম মিলনায়তনে এক সংবাদ সম্মেলনে সংগঠনটির নেতারা এ হুমকি দেন। এসময় লিখিত বক্তব্য পাঠ করেন বিপিএ সভাপতি সুমন হাওলাদার।
সুমন বলেন, দেশের প্রান্তিক খামারিরা প্রতিকূল পরিবেশেও উৎপাদন চালিয়ে যাচ্ছেন। কিন্তু ফিডের অযৌক্তিক মূল্যবৃদ্ধি, করপোরেট সিন্ডিকেটের একচেটিয়া নিয়ন্ত্রণ ও সরকারের কার্যকর তদারকির অভাবে পুরো পোলট্রি খাত গভীর সংকটে নিমজ্জিত। সরকারের পর্যাপ্ত নজরদারি না থাকায় এ খাতে প্রকৃত অর্থে চলছে অর্থনৈতিক হরিলুট।
সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়, গত ১৬ বছর ধরে দেশের কয়েকটি বড় করপোরেট গ্রুপ নিজেদের স্বার্থ রক্ষার জন্য ‘বাংলাদেশ পোলট্রি ইন্ডাস্ট্রিজ সেন্ট্রাল কাউন্সিল (বিপিআইসিসি)’ নামের নিবন্ধনহীন ও বেআইনি সংগঠন গঠন করেছে। এ সংগঠন কোনো সরকারি স্বীকৃতি বা তদারকির আওতায় নেই। তবুও তারা ফিড, বাচ্চা এবং টিকা ও ওষুধের বাজার প্রভাবিত করছে এবং প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয় ও অধিদপ্তরের নীতি-নির্ধারণ প্রক্রিয়ায় সরাসরি অংশ নিচ্ছে। ফলে দেশের প্রকৃত উৎপাদক অর্থাৎ প্রান্তিক খামারিদের সংগঠন বিপিএকে আলোচনায় অন্তর্ভুক্ত করা হচ্ছে না।
বিপিএ সভাপতি অভিযোগ করেন, প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা মাঠপর্যায়ের বাস্তব পরিস্থিতি না জেনে কেবল করপোরেট গ্রুপের পরামর্শে কাজ করছেন। অতীতে প্রান্তিক খামারিদের প্রতিনিধিত্বের প্রতিশ্রুতি দেওয়া হলেও তা বাস্তবায়িত হয়নি। বরং কিছু সান্ত্বনা পুরস্কার ও ফটোসেশন দেখিয়ে সমস্যার মূল বিষয় আড়াল করা হয়েছে। তারা সান্ত্বনার ভেতরে থাকতে চান না, তারা ন্যায্যতার ভেতরে থাকতে চান। তাদের দাবি, মাঠের বাস্তবতাকে ভিত্তি করে নীতি প্রণয়ন করতে হবে এবং সরকারি সিদ্ধান্তে প্রান্তিক খামারিদের প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করতে হবে।
সুমন বলেন বলেন, ২০২৩ সালে ট্রেড অ্যান্ড ট্যারিফ কমিশনের এক গবেষণায় উঠে এসেছে যে বাংলাদেশের বাজারে প্রতি কেজি ফিডে ১৫ থেকে ২০ টাকা অতিরিক্ত দাম নেওয়া হচ্ছে। সরকার তবুও কেন নীরব ভূমিকা পালন করছে ফিডের দাম কমাতে? পার্শ্ববর্তী দেশের বাজারে প্রতি কেজি ফিডের দাম যদি ৩২-৪০ টাকার মধ্যে হয়, একটি ডিম উৎপাদন খরচ যদি পাঁচ টাকা এবং এক কেজি ব্রয়লার মুরগির উৎপাদন খরচ ৮০-৯০ টাকা হয়, তাহলে বাংলাদেশের বাজারে কেন একটি ডিমের উৎপাদন খরচ ১০ টাকা ও এক কেজি ব্রয়লার মুরগি ১৫০-১৬৫ টাকা হয়?
দেশের বাজারে সিন্ডিকেট যখন থামানো যাচ্ছে না, আমাদের উচিত যেভাবে চাল, ডাল, পেঁয়াজ আমদানি করি ঠিক একইভাব ফিড, মুরগির বাচ্চা এবং ওষুধ ও টিকা পার্শ্ববর্তী দেশগুলো থেকে আমদানি করা। তাহলে সিন্ডিকেট বিলুপ্ত হবে বলে আমাদের বিশ্বাস। দেশের ফিড মিল ও হ্যাচারিদের সুবিধা দিতে গিয়ে প্রান্তিক খামারিদের উৎপাদন খরচ বেড়ে যাচ্ছে। বেড়ে যাচ্ছে ডিম ও মুরগির দাম। এর ফলে সাধারণ মানুষ তাদের প্রোটিনের চাহিদা পূরণ করতে হিমশিম খাচ্ছে- জানান বিপিএ সভাপতি।
সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়, ২০২১ সালে ৫০ কেজি লেয়ার ফিডের দাম এক হাজার ৮০০ থেকে দুই হাজার, ব্রয়লার মুরগির ফিড দুই হাজার ২০০ থেকে দুই হাজার ৪০০ ও একটি মুরগির বাচ্চার উৎপাদন খরচ ২০ থেকে ২২ টাকা ছিল। ২০২২ সালে ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের অজুহাত দেখিয়ে ফিড কোম্পানি বস্তা প্রতি দাম এক হাজার থেকে এক হাজার ২০০ টাকা বৃদ্ধি করে। পরে আন্তর্জাতিক বাজারে কাঁচামালের দাম অর্ধেক নেমে গেলেও বাংলাদেশে ফিডের দাম অপরিবর্তিত রয়েছে। প্রতি কেজিতে সয়াবিন মিল (কেক) ৭০-৮০ টাকা থেকে ৪৫-৫০ ও ভুট্টা ৪০-৪৫ টাকা থেকে ২০-৩০ টাকা দাম কমেছে। কিন্তু ২৮-৩০ টাকার উৎপাদন খরচের বাচ্চা বর্তমানে ৫০-৬০ টাকায় বিক্রি করা হচ্ছে। কখনো কখনো ৮০-১০০ টাকায় বিক্রি করা হয়। মাঝেমধ্যে আবার ১০-১৫ টাকায় বিক্রি করে ছোট হ্যাচারিগুলোকে ক্ষতির মুখে ফেলে বাজার থেকে সরানো হচ্ছে। ফলে খামারিরা প্রতিটি ডিমে দুই থেকে চার টাকা এবং প্রতি কেজি ব্রয়লারে ৩০ থেকে ৪০ টাকা ক্ষতির মুখে পড়ছে। ১০-১২টি করপোরেট গ্রুপ একচেটিয়া বাজার নিয়ন্ত্রণ করছে।
সংবাদ সম্মেলনে অভিযোগ করা হয়, করপোরেট সিন্ডিকেট সরকারকে বিভ্রান্ত করছে, বিকৃত (ভুল) তথ্য দিয়ে নিজেদের নির্দোষ প্রমাণ করছে। বাস্তবে তারা বাজারের প্রতিটি স্তরে নিয়ন্ত্রণ করে। অতি শিগগিরই যদি সিন্ডিকেটকে নিয়ন্ত্রণ না করা হয় তাহলে প্রান্তিক খামারিরা একে একে বাজার থেকে বিলুপ্ত হয়ে যাবেন।
তাই প্রান্তিক খামারিদের সার্বিক দিক বিবেচনা করে বিপিএ সাত দফা দাবি বাস্তবায়ন করার আহ্বান জানিয়েছে। এগুলো হলো-
১. করপোরেট সিন্ডিকেট ভেঙে দিয়ে ফিড, মুরগির বাচ্চা ও ওষুধ-টিকার দাম সরকারের নির্ধারণ করতে হবে।
২. অবিলম্বে করপোরেট প্রভাবমুক্ত, ন্যায্য ও স্বচ্ছ বাজার ব্যবস্থাপনা গড়ে তুলতে হবে।
৩. প্রান্তিক খামারিদের সংগঠনের প্রতিনিধিদের নীতিনির্ধারণ পর্যায়ে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে।
৪. ফিড, বাচ্চা ও ওষুধের বাজারে নিয়মিত নিরীক্ষাব্যবস্থা চালু করতে হবে।
৫. উৎপাদন খরচ অনুযায়ী ১০ শতাংশ লাভ যুক্ত করে ডিম ও মুরগির ন্যায্যদাম নির্ধারণ করতে হবে।
৬. ক্ষতিগ্রস্ত খামারিদের জন্য প্রণোদনা, সহজ শর্তে জামানতবিহীন ঋণ ও ভর্তুকি দিতে হবে।
৭. দুর্নীতিগ্রস্ত ও করপোরেটপন্থি কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে।
বিপিএ সভাপতি বলেন, সিন্ডিকেট আগের সরকারের সময় সক্রিয় ছিল, বর্তমান সরকারের সময়েও বিদ্যমান। প্রান্তিক খামারিরা আজ ক্ষতিগ্রস্ত এবং ন্যায্যমূল্য পাচ্ছেন না। বিগত দিনে তারা বারবার দাবি তুলে ধরেছেন, খামার বন্ধের কর্মসূচি বাস্তবায়ন করেছেন এবং ধৈর্যের সঙ্গে আলোচনা চালিয়েছেন। তারা সরকারকে সম্মান দেখিয়েছেন, কিন্তু তাদের দাবিগুলো বাস্তবায়িত হয়নি। ফলে তারা বাধ্য হচ্ছেন স্পষ্টভাবে ঘোষণা করতে- এসব দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত খামারে উৎপাদন স্থগিত থাকবে।
বিপিএর ঘোষণা অনুযায়ী, আগামী ১৫ দিনের মধ্যে যদি সরকার নিবন্ধনহীন সংগঠন বিপিআইসিসিসহ ১০-১২টি কোম্পানির একচেটিয়া বাজার নিয়ন্ত্রণ বন্ধ না করে এবং বিপিএর সাত দফা দাবি বাস্তবায়নে ব্যর্থ হয়, তাহলে সারাদেশের প্রান্তিক খামারিরা আগামী ১ নভেম্বর থেকে পর্যায়ক্রমে খামার বন্ধ ও ডিম-মুরগি উৎপাদন স্থগিত কর্মসূচি শুরু করবে। এ কর্মসূচি চলবে যত দিন পর্যন্ত সরকার থেকে বাস্তব পদক্ষেপ না নেওয়া হবে।
সংবাদ সম্মেলনে আরও উপস্থিত ছিলেন বিপিএর সিনিয়র সহ-সভাপতি বাপ্পি কুমার দে, সাধারণ সম্পাদক ইলিয়াস খন্দকার, সাংগঠনিক সম্পাদক ইকবাল হোসেন, যুগ্ম সাধারণ মো. সোহেল রানা প্রমুখ।