বাংলাদেশ ব্যাংক ইসলামী ব্যাংকিং খাতে শরিয়াহ সুপারভাইজরি কমিটি গঠনকে বাধ্যতামূলক করেছে এবং সদস্যদের যোগ্যতা, দায়িত্ব-কর্তব্য, কার্যবিবরণীসহ বিস্তারিত নীতিমালা প্রকাশ করেছে। নতুন এই নির্দেশনা ২০২৬ সালের ১ জানুয়ারি থেকে কার্যকর হবে।
নতুন নীতিমালায় বলা হয়েছে, কোনো ব্যাংকের কার্যক্রমে শরিয়াহ নন-কমপ্লায়েন্স শনাক্ত হলে ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদকে কমিটির পরামর্শ অনুযায়ী তাৎক্ষণিক সংশোধনমূলক ও প্রতিরোধমূলক পদক্ষেপ নিতে হবে। ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ এবং ব্যবস্থাপনা এই সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে বাধ্য থাকবে।
এছাড়া সুপারভাইজরি কমিটি ও ব্যাংকের নির্বাহী, অডিট বা অন্যান্য কমিটিতে শরিয়াহসংক্রান্ত কোনো মতবিরোধ দেখা দিলে বিষয়টি বাংলাদেশ ব্যাংককে জানাতে হবে।
প্রতিটি ব্যাংকে ৩ বা ৫ সদস্যবিশিষ্ট শরিয়াহ সুপারভাইজরি কমিটি গঠন করতে হবে। সদস্যদের স্বীকৃত বিশ্ববিদ্যালয় বা প্রতিষ্ঠানের কামিল, দাওরা-ই-হাদিস, ইসলামিক স্টাডিজ, ইসলামী অর্থনীতি, ইসলামী ফাইন্যান্স, ইসলামী ব্যাংকিং বা ইসলামী আইন বিষয়ে স্নাতক ডিগ্রি থাকতে হবে। শিক্ষাজীবনের কোনো পর্যায়ে তৃতীয় বিভাগ গ্রহণযোগ্য হবে না।
অতিরিক্ত যোগ্যতা হিসেবে পিএইচডি বা সমমানের উচ্চতর ডিগ্রিও বিবেচিত হবে। এছাড়া প্রার্থীর অন্তত দুই বছরের শিক্ষকতা, মুফতি বা কোনো ব্যাংকের শরিয়াহ কমিটিতে কাজ করার অভিজ্ঞতা থাকতে হবে। ইসলামী ব্যাংকিং বা অর্থনীতি বিষয়ে গবেষণা নিবন্ধ বা প্রকাশিত বইও যোগ্যতার মধ্যে গণ্য হবে।
শরিয়াহ সুপারভাইজরি কমিটির সদস্যদের অবশ্যই লিখিতভাবে ঘোষণা দিতে হবে যে তারা কখনো ফৌজদারি অপরাধে দণ্ডিত হননি, জালিয়াতি বা আর্থিক অপরাধে জড়িত নন, ঋণখেলাপি নন এবং কোনো ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ বা লাভজনক পদে নেই।
এ ছাড়া সংশ্লিষ্ট ব্যাংকের স্বার্থসংশ্লিষ্ট কোনো ব্যবসা বা প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে তাদের সরাসরি বা পরোক্ষ সম্পর্ক থাকতে পারবে না।
নতুন নীতিমালায় বলা হয়েছে, সদস্যরা সাধারণত তিন বছরের জন্য নিয়োগ পাবেন। তবে সর্বোচ্চ ছয় বছর দায়িত্ব পালন করতে পারবে এবং এরপর দুই বছরের বিরতি নিতে হবে। একজন সদস্য সর্বোচ্চ তিনটি ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠানের কমিটিতে থাকতে পারবে। সদস্যদের মাসিক সম্মানী নির্ধারণ করা হয়েছে ২৫ হাজার টাকা এবং প্রতিটি সভায় অংশগ্রহণের জন্য ৮ হাজার টাকা ভাতা।
পরিচালনা পর্ষদ বিশেষ কারণে সদস্য অপসারণ করতে পারবে, তবে তার জন্য বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুমোদন বাধ্যতামূলক। সদস্যরা লিখিত নোটিশ দিয়ে পদত্যাগ করতে পারবেন। কমিটির মধ্যে একজনকে তিন বছরের জন্য চেয়ারম্যান নির্বাচিত করা হবে। অন্যদিকে ব্যাংকের শরিয়াহ সচিবালয়ের প্রধান সচিব হিসেবে দায়িত্ব পালন করবেন, তবে তার ভোটাধিকার থাকবে না।
প্রতিটি ব্যাংকে একটি শরিয়াহ সচিবালয় গঠন বাধ্যতামূলক। সচিবালয় কমিটিকে সভার এজেন্ডা প্রস্তুত, কার্যবিবরণী সংরক্ষণ এবং শরিয়াহ বিষয়ে মতামত প্রদানে সহায়তা করবে। সচিবালয়ের অধীনে থাকবে অভ্যন্তরীণ শরিয়াহ অডিট ও রিভিউ বিভাগ, শরিয়াহ কমপ্লায়েন্স বিভাগ এবং গবেষণা বিভাগ।
শরিয়াহ সুপারভাইজরি কমিটির প্রধান দায়িত্বের মধ্যে রয়েছে ব্যাংকের নীতি, বিধি, ম্যানুয়াল, চুক্তি, পণ্য, সেবা ও প্রচারণা শরিয়াহসম্মত কি না যাচাই করা। এ ছাড়া লাভ-ক্ষতি ও বিনিয়োগ হিসাবায়ন প্রক্রিয়া তদারকি, যাকাত হিসাব ও বণ্টন, ক্বারজ তহবিলের উৎস ও ব্যবহার পর্যালোচনা এবং নতুন পণ্য চালুর আগে ফতোয়া বা ঘোষণা প্রদান করা। ব্যাংকের কার্যক্রমে শরিয়াহ নীতিমালার বাইরে কোনো পণ্য চালু করতে হলে বাংলাদেশ ব্যাংকের পূর্বানুমোদন নিতে হবে।
প্রতি বছর শরিয়াহ সচিবালয় একটি অডিট পরিকল্পনা তৈরি করবে, যা সুপারভাইজরি কমিটি অনুমোদন দেবে। আপত্তিজনক বিষয় ত্রৈমাসিক ভিত্তিতে পর্যালোচনা করা হবে এবং গুরুতর অনিয়ম ধরা পড়লে পরিচালনা পর্ষদকে অবহিত করা হবে। সদস্যদের বছরে অন্তত ৭৫ শতাংশ সভায় উপস্থিত থাকতে হবে। ধারাবাহিক তিনবার অনুপস্থিত থাকলে পদ শূন্য বলে গণ্য হবে। এ ছাড়া সদস্যদের গোপনীয়তা রক্ষার বিষয়েও কঠোর নির্দেশনা রয়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংক আশা করছে, নতুন নীতিমালা ইসলামী ব্যাংকিং খাতে স্বচ্ছতা, জবাবদিহি এবং শরিয়াহসম্মত অনুশীলন আরো জোরদার করবে।