নরসিংদীর মাধবদীতে শুক্রবার দুপুরে হওয়া শক্তিশালী ভূমিকম্পে কেঁপে উঠেছিল পুরো বাংলাদেশ। এখন পর্যন্ত অন্তত ১০ জনের মৃত্যু এবং পাঁচ শতাধিক মানুষ আহত হওয়ার খবর পাওয়া গেছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, এটি শুধু একটি ভূমিকম্প নয় বরং একটি বড় সতর্কবার্তা, যা জানিয়ে দিচ্ছে, পূর্ব বাংলাদেশে ৮.২ থেকে ৯ মাত্রার বিধ্বংসী ভূমিকম্পের ঝুঁকি ক্রমেই বাড়ছে।
যুক্তরাষ্ট্রের ভূতাত্ত্বিক জরিপ সংস্থা (ইউএসজিএস) জানায়, শুক্রবারের ভূমিকম্পে দেশের প্রায় ৭ কোটি মানুষ হালকা বা মাঝারি ঝাঁকুনি অনুভব করেছেন। ঢাকার মাত্র ৩০ কিলোমিটার উত্তর-পূর্বে মাধবদীতে মাটির ১০ কিলোমিটার গভীরে উৎপত্তিস্থল— মাত্র কয়েক সেকেন্ডের এই কম্পনকে স্মরণকালের মধ্যে সবচেয়ে শক্তিশালী বলে উল্লেখ করেছে আবহাওয়া অধিদপ্তর।
এরপর শনিবার (২৩ নভেম্বর) সকালে একই জেলার পলাশ উপজেলায় আবারও রিখটার স্কেলে ৩.৩ মাত্রার ভূমিকম্প অনুভূত হয় বলে নিশ্চিত করেছে আবহাওয়া অধিদপ্তরের ভূমিকম্প পর্যবেক্ষণ ও গবেষণা কেন্দ্র।
কেন ঘটল এই ভূমিকম্প?
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূতত্ত্ব বিভাগের সাবেক অধ্যাপক ও ভূমিকম্প বিশেষজ্ঞ সৈয়দ হুমায়ুন আখতার বলেন, ইন্ডিয়ান প্লেট ও বার্মিজ প্লেটের অবস্থান পরিবর্তন এবং সাপেক্ষে নড়াচড়ার কারণেই মাধবদীর এই ভূমিকম্প হয়েছে। ভূগর্ভে দীর্ঘদিন ধরে জমে থাকা শক্তি একসময় বের হয়েই যায়।
তিনি বলেন,
“সিলেট থেকে চট্টগ্রাম–টেকনাফ পর্যন্ত বিস্তৃত সাবডাকশন জোন অত্যন্ত ভয়ংকর। এখানে ৮.২ থেকে ৯ মাত্রার ভূমিকম্পের মতো শক্তি জমে আছে। মাধবদীর ভূমিকম্প সেই শক্তির খুব ক্ষুদ্র অংশ মুক্তির ফল।”
নরসিংদী অঞ্চলে ভারতীয় প্লেট পূর্ব দিকে অগ্রসর হয়ে বার্মা প্লেটের নিচে ঢুকে যাচ্ছে। প্লেট দুটি দীর্ঘদিন ‘লকড’ ছিল। শুক্রবার সেই লকড অংশের একটি ছোট অংশ ভেঙে গেছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, এর অর্থ— আরও বড় কম্পন সামনে অপেক্ষা করছে।
—
৮০০ বছর ধরে জমছে শক্তি
বিশেষজ্ঞদের মতে, বাংলাদেশ অঞ্চলে দুই টেকটনিক প্লেটের সংযোগস্থলে প্রায় ৮০০ বছর ধরে শক্তি জমে আছে। অধ্যাপক আখতার বলেন,
“এ শক্তি অবশ্যই বের হবে। মাধবদীর ভূমিকম্প ছিল একটি বড় আগাম সতর্কবার্তা। এত বড় প্লেট বাউন্ডারির সামান্য অংশ নড়েছে— মানে সামনে আরও বিপদ।”
বাংলাদেশে কোন কোন ফল্ট সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ?
বিশেষজ্ঞরা দুটি প্রধান উৎস চিহ্নিত করেছেন—
১. ডাউকি ফল্ট
ময়মনসিংহ–জামালগঞ্জ–সুনামগঞ্জ–সিলেট অঞ্চলজুড়ে, দৈর্ঘ্য প্রায় ৩৫০ কিমি।
২. পূর্বাঞ্চলীয় সাবডাকশন জোন
সিলেট থেকে চট্টগ্রাম–পার্বত্য চট্টগ্রাম–টেকনাফ হয়ে সুমাত্রা পর্যন্ত বিস্তৃত।
নরসিংদীর মাধবদী ঠিক এই দ্বিতীয় জোনের অংশ।
ইউএসজিএস বলছে, ১৯৫০ সালের পর থেকে এই অঞ্চলে ৫.৫ মাত্রা বা তার বেশি শক্তির ১৪টি ভূমিকম্প রেকর্ড হয়েছে।
ইতিহাসে বড় ভূমিকম্পের নজির
বাংলাদেশ উপকূলবর্তী অঞ্চলে অতীতে একাধিক ধ্বংসাত্মক ভূমিকম্প ঘটেছে।
৭৬২ সালে: ৮.৫ মাত্রার ভূমিকম্পে সেন্টমার্টিন দ্বীপ তিন মিটার ওপরে উঠে আসে।
১৭৯৭ সালে: ব্রহ্মপুত্র নদীর গতিপথ বদলে যায়।
১৮৯৭ সালে: ডাউকি ফল্টে ৮.৭ মাত্রার ভূমিকম্প— অঞ্চলটির সবচেয়ে বড় কম্পনগুলোর একটি।
১৮৬৮ ও ১৯২২ সালে: সিলেট–মৌলভীবাজার–কিশোরগঞ্জ অঞ্চলে ৭.৫ ও ৭.৬ মাত্রার কম্পন।
এইসব উদাহরণ প্রমাণ করে— বড় ভূমিকম্প বাস্তব সম্ভাবনা, কল্পনা নয়।
ঢাকার ঝুঁকি সবচেয়ে বেশি
অধ্যাপক হুমায়ুন আখতার সতর্ক করে বলেন,
“এখন বড় ভূমিকম্প হলে ঢাকার পরিকল্পনাহীন নগরায়ন, দুর্বল ভবন ও ঘনবসতিপূর্ণ এলাকার কারণে শহরটি ভয়াবহ মৃত্যুপুরীতে পরিণত হতে পারে।”
ঢাকার ভবন কাঠামো দুর্বল, সড়ক সংকীর্ণ, জরুরি সেবা সীমিত— ফলে যেকোনো উৎসেই উৎপত্তিস্থল হোক, সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হবে এখানেই।
তিনি বলেন,
“সময় খুব কম। অবিলম্বে ভবন নিরাপত্তা সোনদ, প্রস্তুতি গ্রহণ ও জরুরি অবকাঠামো জোরদার করতে হবে।”
