অন্তর্বর্তী সরকার দেশের সব প্রাথমিক বিদ্যালয়ে সংগীত শিক্ষক নিয়োগের যে সিদ্ধান্ত নিয়েছে, তার কঠোর সমালোচনা করেছেন জামায়াতে ইসলামীসহ ধর্মভিত্তিক পাঁচটি দলের নেতারা। তাঁরা বলেছেন, সংগীত শিক্ষকের জায়গায় সরকারকে ধর্মীয় শিক্ষক নিয়োগ দিতে হবে। এর ব্যতিক্রম হলে দেশের ইসলামপ্রেমিক জনগণ রাজপথে নামতে বাধ্য হবেন।
আজ মঙ্গলবার দুপুরে রাজধানীর ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশন মিলনায়তনে এক সেমিনারে এসব কথা বলেন জামায়াতে ইসলামী, ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ, খেলাফত মজলিস, বাংলাদেশ খেলাফত মজলিস ও বাংলাদেশ খেলাফত আন্দোলনের নেতারা। দেশের সব প্রাথমিক বিদ্যালয়ে বাধ্যতামূলক ধর্মীয় শিক্ষক নিয়োগের দাবিতে এই সেমিনারের আয়োজন করে জাতীয় ওলামা মাশায়েখ আইম্মা পরিষদ।
সেমিনারে মূল প্রবন্ধ পাঠ করেন মুফতি আব্দুল্লাহ মাসুম ও মুফতি ইউসুফ সুলতান। এতে ছয়টি প্রস্তাব তুলে ধরা হয়। এগুলো হলো প্রতিটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে একজন করে যোগ্য ও স্বতন্ত্র ধর্মীয় শিক্ষক নিয়োগ দেওয়া; ধর্মীয় শিক্ষক পদে আলিয়া মাদ্রাসা থেকে কামিল অথবা আল হাইয়াতুল উলয়া থেকে দাওরায়ে হাদিস পাস করা ব্যক্তিদের নিয়োগ দেওয়া, ধর্মীয় শিক্ষক নিয়োগে ধর্ম মন্ত্রণালয়কে সম্পৃক্ত করে একটি স্বতন্ত্র নিয়োগপ্রক্রিয়া নিশ্চিত করা, সম্প্রতি প্রকাশিত ‘সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় শিক্ষক নিয়োগ বিধিমালা-২০২৫’ গেজেট সংশোধন করে তাতে ধর্মীয় শিক্ষক নিয়োগের বিধান সংযোজন করা; নিয়োগপ্রাপ্ত শিক্ষকদের জন্য ধর্ম মন্ত্রণালয় ও শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের যৌথ উদ্যোগে নিয়মিত প্রশিক্ষণ ও মানোন্নয়নের ব্যবস্থা করা এবং অন্যান্য ধর্মাবলম্বী (হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিষ্টান) শিক্ষার্থীদের জন্যও তাদের ধর্ম অনুযায়ী শিক্ষক নিয়োগের ব্যবস্থা রাখা।
সেমিনারে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে সংগীত শিক্ষক নিয়োগের সরকারি সিদ্ধান্তের কঠোর সমালোচনা করেন ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের আমির মুফতি সৈয়দ মুহাম্মাদ রেজাউল করীম। তিনি বলেন, লেখাপড়ার মানের অবনতির কারণে সারা দেশের প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলো শিক্ষার্থীশূন্য হয়ে যাচ্ছে, বাচ্চাদের মানসিক ও আদর্শিক ঘাটতি দেখা যাচ্ছে। সরকার সেদিকে লক্ষ না করে গানের জন্য শিক্ষক নিয়োগ দিচ্ছে। এর প্রতিবাদ জানাতে হবে। প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ধর্মীয় শিক্ষক নিয়োগ দিতে হবে। এর ব্যতিক্রম হলে দেশের ইসলামপ্রেমিক জনগণ রাজপথে নামতে বাধ্য হবেন।
ইসলামপন্থীদের দাবি আদায়ের জন্য ক্ষমতায় যাওয়া প্রয়োজন বলে উল্লেখ করেন সৈয়দ মুহাম্মাদ রেজাউল করীম। তিনি বলেন, মূল জায়গায় (সরকারে) না যেতে পারলে যারা সরকারে থাকে, তারা তাদের মতো করে কাজ করে যাবে। সৈয়দ রেজাউল করীম বলেন, এখন ইসলামের পক্ষে একটি মাঠ তৈরি হয়েছে। বাংলাদেশের মানুষ ইসলামের পক্ষে মানসিকসহ সব দিক দিয়ে তৈরি হয়ে অপেক্ষায় আছেন। যাঁরা এর নেতৃত্ব দিচ্ছেন, তাঁরা সঠিক নেতৃত্ব দিতে ব্যর্থ হলে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম তাঁদের ধিক্কার দিয়ে ইতিহাস রচনা করবে। তাই উলামায়ে কেরামকে তাঁদের দায়িত্ব সম্পর্কে সচেতন হতে হবে।
ইসলামী আন্দোলনের আমির বলেন, ইসলামপন্থী দলগুলোর মধ্যে চিন্তার ব্যবধান থাকতে পারে। কিন্তু পরগাছা হয়ে মূল গাছের ভূমিকা পালন করা যায় না। এখন গাছ হওয়ার মতো পরিবেশ তৈরি হয়েছে।
সেমিনারে জামায়াতে ইসলামীর কেন্দ্রীয় কর্মপরিষদ সদস্য খলিলুর রহমান মাদানী বলেন, প্রাথমিক বিদ্যালয়ে গানের শিক্ষক বাদ দিয়ে ধর্মীয় শিক্ষক নিয়োগ দিতে হবে। গানের শিক্ষক নিয়োগ দেওয়ার চেষ্টা করেছিল পতিত ফ্যাসিবাদী সরকার। তাই এই সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসতে হবে অন্তর্বর্তী সরকারকে। আলেম-ওলামাদের মনমতো দেশ গঠনের আগে নির্বাচনের আয়োজন করা যাবে না। নইলে একটি বিপদের জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে।
খেলাফত মজলিসের মহাসচিব আহমদ আবদুল কাদের বলেন, ধর্মীয় শিক্ষক না থাকায় অনেক প্রতিষ্ঠানে ভিন্ন ধর্মের শিক্ষক দিয়ে বাচ্চাদের পাঠদান করাতে হচ্ছে। দেশের বেশির ভাগ মানুষ চায় তাদের সন্তানেরা ধর্মীয় শিক্ষা গ্রহণ করুক। বর্তমান শিক্ষাব্যবস্থায় ধর্মীয় শিক্ষকের চাহিদা পূরণ হচ্ছে না, সমস্যারও সমাধান হচ্ছে না। তাই এই শিক্ষাব্যবস্থা পাল্টাতে হবে।
ইসলামপন্থীদের ক্ষমতায় আনার মাধ্যমেই বিভিন্ন সমস্যার সমাধান করা সম্ভব উল্লেখ করে আহমদ আব্দুল কাদের বলেন, সামনে নির্বাচন, ইসলামপন্থীদের ঐক্যবদ্ধভাবে আন্দোলন করতে হবে। রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে যারা ইসলামবিদ্বেষী নয়, তাদের সঙ্গে নিয়ে চলতে হবে।
বাংলাদেশ খেলাফত মজলিসের মহাসচিব জালালুদ্দিন আহমদ বলেন, গান শেখা ঐচ্ছিক, তবে ধর্মীয় শিক্ষা ঐচ্ছিক নয়। সরকারের সিদ্ধান্ত থেকে তারা কী করতে চায়, সেই মনোভাব পরিষ্কার হয়েছে। ইসলামপন্থীরা ক্ষমতায় আসতে পারলে বিশেষ করে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে আমূল পরিবর্তন করতে হবে। প্রাথমিক বিদ্যালয়ে গানের শিক্ষক নিয়োগের প্রজ্ঞাপন বাতিল করে ধর্মীয় শিক্ষা কারিকুলাম এসব প্রতিষ্ঠানে বাধ্যতামূলক করতে হবে।
ইসলামী আন্দোলনের মহাসচিব মাওলানা ইউনুছ আহমাদ বলেন, যেই চেয়ারে বসে ইসলামবিরোধী সিদ্ধান্তগুলো নেওয়া হয়, সেখানে বসতে হবে। এর বিকল্প নেই। এখন সেই ক্ষেত্র তৈরি হয়েছে। এ জন্য দলগুলোকে ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করতে হবে।
সেমিনারে সমকামিতা বিষয়ে একটি পাওয়ারপয়েন্ট উপস্থাপনা দেন ইনডিপেনডেন্ট ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশের শিক্ষক মোহাম্মদ সারোয়ার হোসেন। তিনি বলেন, শব্দের মারপ্যাঁচে সমকামিতা এ দেশে প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা করা হচ্ছে। সরাসরি ট্রান্সজেন্ডার না বলে ইনক্লুসিভ, বহুত্ববাদ অনেক শব্দ ব্যবহার করা হচ্ছে।
সেমিনার থেকে জাতীয় ওলামা-মাশায়েখ আইম্মা পরিষদের পক্ষ থেকে আগামী শুক্রবার বাদ জুমা দেশের সব প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ধর্মীয় শিক্ষক নিয়োগ দেওয়ার দাবিতে বিক্ষোভ মিছিলের ঘোষণা দেওয়া হয়।
জাতীয় ওলামা মাশায়েখ আইম্মা পরিষদের সভাপতি মাওলানা নুরুল হুদা ফয়েজির সভাপতিত্বে এবং সাধারণ সম্পাদক রেজাউল করিম আবরার ও যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মুফতি শামসুদ্দোহা আশরাফীর সঞ্চালনায় সেমিনারে আরও বক্তব্য দেন ইসলামিক ফাউন্ডেশনের গভর্নর ও ইসলামী আন্দোলনের নেতা মোসাদ্দেক বিল্লাহ আল-মাদানি, বাংলাদেশ খেলাফত মজলিসের যুগ্ম মহাসচিব মাওলানা আতাউল্লাহ আমীন, বাংলাদেশ খেলাফত আন্দোলনের সাংগঠনিক সম্পাদক সুলতান মহিউদ্দিন, হেফাজতে ইসলামের নেতা মাওলানা হাসান জামিল প্রমুখ।