বিএনপির চেয়ারপারসন ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া ইন্তেকাল করেছেন। মঙ্গলবার (৩০ ডিসেম্বর) ভোর ৬টায় রাজধানীর এভারকেয়ার হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন (ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন)। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল ৮০ বছর।
বিএনপি মিডিয়া সেল বিষয়টি নিশ্চিত করেছে। তাঁর ইন্তেকালে দেশজুড়ে রাজনৈতিক অঙ্গনে শোকের ছায়া নেমে এসেছে।
জন্ম ও পারিবারিক জীবন
বেগম খালেদা জিয়া ১৯৪৬ সালের ১৫ আগস্ট দিনাজপুর জেলায় জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর বাবা ইস্কান্দার মজুমদার এবং মা তৈয়বা মজুমদার। দেশভাগের পর তাঁর বাবা ভারতের জলপাইগুড়ি থেকে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে চলে আসেন। তাঁদের আদি নিবাস ফেনী জেলায়।
তিনি দিনাজপুর সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ে পড়াশোনা করেন এবং পরে সুরেন্দ্রনাথ কলেজে অধ্যয়ন করেন। ১৯৬০ সালে তিনি তৎকালীন সেনা কর্মকর্তা, পরবর্তীতে রাষ্ট্রপতি ও বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের সঙ্গে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন।
রাজনীতিতে আগমন
১৯৮১ সালে এক ব্যর্থ সামরিক অভ্যুত্থানে জিয়াউর রহমান নিহত হওয়ার পর ১৯৮২ সালের ২ জানুয়ারি সাধারণ সদস্য হিসেবে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি)-তে যোগ দেন খালেদা জিয়া।
১৯৮৩ সালের মার্চে তিনি দলের ভাইস-চেয়ারম্যান এবং ১৯৮৪ সালের আগস্টে বিএনপির চেয়ারপারসন নির্বাচিত হন।
সেনাপ্রধান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের নেতৃত্বে সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের আন্দোলনে তিনি সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন। সাত দলীয় জোটের অন্যতম স্থপতি হিসেবে স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়ে তিনি ‘আপোশহীন নেত্রী’ হিসেবে পরিচিতি লাভ করেন।
প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব
১৯৯১ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠিত অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে বেগম খালেদা জিয়া বাংলাদেশের প্রথম নারী প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হন। তাঁর নেতৃত্বে দেশে সংসদীয় গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হয়।
এই সময়ে দেশে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে গতি আসে। কর্মসংস্থান বৃদ্ধি পায়, বিশেষ করে তৈরি পোশাক খাতে পাঁচ বছরে প্রায় ২৯ শতাংশ কর্মসংস্থান বৃদ্ধি ঘটে এবং প্রায় দুই লাখ নারী শ্রমবাজারে যুক্ত হন।
আন্তর্জাতিক অঙ্গনে ভূমিকা
প্রধানমন্ত্রী হিসেবে তিনি জাতিসংঘে গঙ্গার পানি বণ্টনের বিষয়টি উত্থাপন করেন। ১৯৯২ সালে হোয়াইট হাউসে আমন্ত্রিত হয়ে রোহিঙ্গা মুসলিম শরণার্থী সংকট তুলে ধরেন। এর ফলশ্রুতিতে মিয়ানমারের সঙ্গে প্রত্যাবাসন চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়।
রাজনৈতিক উত্থান-পতন
১৯৯৬ সালে বিএনপি নির্বাচনে জয়ী হলেও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে এক মাসের মাথায় তিনি পদত্যাগ করেন। পরবর্তী নির্বাচনে বিএনপি বিরোধী দল হিসেবে সংসদে ১১৬টি আসন পায়।
২০০১ সালের নির্বাচনে চারদলীয় জোটের নেতৃত্ব দিয়ে তিনি পুনরায় ক্ষমতায় আসেন।
শিক্ষা ও সামাজিক খাতে অবদান
খালেদা জিয়ার সরকার বাধ্যতামূলক বিনামূল্যে প্রাথমিক শিক্ষা, দশম শ্রেণি পর্যন্ত মেয়েদের বিনামূল্যে শিক্ষা, ছাত্রী উপবৃত্তি ও খাদ্যের বিনিময়ে শিক্ষা কর্মসূচি চালু করে। সরকারি চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা বৃদ্ধি এবং শিক্ষা খাতে সর্বোচ্চ বাজেট বরাদ্দ দেওয়া হয়।
আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি
নারী শিক্ষা ও ক্ষমতায়নে অবদানের জন্য ২০০৫ সালে ফোর্বস ম্যাগাজিন তাঁকে বিশ্বের সবচেয়ে ক্ষমতাধর নারীদের তালিকায় ২৯তম স্থানে স্থান দেয়।
কারাবাস ও অসুস্থতা
২০০৭ সালে সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় এবং ২০১৮ সালে আওয়ামী লীগ সরকার আমলে দুর্নীতির মামলায় তাঁকে কারাবরণ করতে হয়। দীর্ঘ কারাবাসে তিনি নানা জটিল রোগে আক্রান্ত হন।
২০২০ সালে শর্তসাপেক্ষে বাসায় থাকার অনুমতি পান।
২০২৪ সালে গণঅভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর উন্নত চিকিৎসার জন্য তাঁকে লন্ডনে নেওয়া হয়। দেশে ফেরার পরও অসুস্থতা কাটেনি। সর্বশেষ ২০২৫ সালের ২৩ নভেম্বর তাঁকে এভারকেয়ার হাসপাতালে ভর্তি করা হয়।
শোকের ছায়া
বেগম খালেদা জিয়ার ইন্তেকালে বিএনপিসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দল, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠন গভীর শোক প্রকাশ করেছে। তাঁর মৃত্যুতে বাংলাদেশের রাজনীতিতে এক গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়ের সমাপ্তি হলো।
