দেশের প্রথম নারী প্রধানমন্ত্রী, তিনবারের নির্বাচিত সরকারপ্রধান ও বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের (বিএনপি) চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া আর নেই। গতকাল মঙ্গলবার (৩০ ডিসেম্বর) ভোর ৬টায় রাজধানীর এভারকেয়ার হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন (ইন্নালিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন)। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল ৮০ বছর।
সকাল সোয়া ৯টায় এভারকেয়ার হাসপাতালে এক সংবাদ সম্মেলনে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বিষয়টি নিশ্চিত করেন। একই সঙ্গে বিএনপির মিডিয়া সেলের ফেসবুক পেজেও খালেদা জিয়ার মৃত্যুর খবর জানানো হয়।
খালেদা জিয়ার মৃত্যুতে তিন দিনের রাষ্ট্রীয় শোক ঘোষণা করেছে অন্তর্বর্তী সরকার। দুপুর ১২টায় জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস এ ঘোষণা দেন। তিনি জানান, জানাজার দিন আজ বুধবার একদিনের সাধারণ ছুটিও ঘোষণা করা হয়েছে।
রাষ্ট্রপতি ও প্রধান উপদেষ্টার শোক
রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন ও প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস খালেদা জিয়ার মৃত্যুতে গভীর শোক প্রকাশ করেছেন। রাষ্ট্রপতি এক শোকবার্তায় বলেন, ‘গণতন্ত্র ও জনগণের অধিকার প্রতিষ্ঠায় বেগম খালেদা জিয়ার আপসহীন ভূমিকা বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে।’
প্রধান উপদেষ্টা বলেন, ‘দেশের গণতান্ত্রিক রাজনীতির শীর্ষ নেত্রী আজ আমাদের মাঝে নেই। পুরো জাতি গভীর শোক ও বেদনায় নিস্তব্ধ।’
জানাজা ও দাফনের সময়সূচি
আজ বুধবার (৩১ ডিসেম্বর) বেলা ২টায় জাতীয় সংসদ ভবনের দক্ষিণ প্লাজা ও মানিক মিয়া অ্যাভিনিউতে খালেদা জিয়ার জানাজা অনুষ্ঠিত হবে। জানাজায় ইমামতি করবেন জাতীয় মসজিদ বায়তুল মোকাররমের খতিব। জানাজা শেষে শেরেবাংলা নগরে জিয়া উদ্যানে তাঁর স্বামী, প্রয়াত রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের কবরের পাশে রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় দাফন করা হবে।
মন্ত্রিপরিষদ সচিব শেখ আব্দুর রশীদ জানান, ৩১ ডিসেম্বর এবং ১ ও ২ জানুয়ারি রাষ্ট্রীয় শোক পালন করা হবে। এ সংক্রান্ত প্রজ্ঞাপন জারি করেছে সরকার।
আন্তর্জাতিক শোক ও প্রতিনিধিদের আগমন
খালেদা জিয়ার মৃত্যুতে জাতিসংঘ, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স, অস্ট্রেলিয়া, চীনসহ বিভিন্ন দেশ ও আন্তর্জাতিক সংস্থা শোক প্রকাশ করেছে। শোক জানিয়েছেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি, পাকিস্তানের রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রী, পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জিসহ বিভিন্ন দেশের রাজনৈতিক নেতারা।
জানাজায় অংশ নিতে ভারত, পাকিস্তান, ভুটান ও মালদ্বীপ থেকে উচ্চপর্যায়ের প্রতিনিধিরা ঢাকায় আসছেন। এর মধ্যে রয়েছেন পাকিস্তানের উপপ্রধানমন্ত্রী ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী ইসহাক দার এবং ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এস জয়শঙ্কর।
শেষ মুহূর্তে স্বজনদের উপস্থিতি
মৃত্যুর সময় খালেদা জিয়ার পাশে ছিলেন তাঁর জ্যেষ্ঠ পুত্র ও বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। এ সময় আরও উপস্থিত ছিলেন তারেক রহমানের স্ত্রী ডা. জুবাইদা রহমান, কন্যা জাইমা রহমান, প্রয়াত পুত্র আরাফাত রহমান কোকোর স্ত্রী শর্মিলা রহমান সিঁথি এবং পরিবারের অন্যান্য সদস্যরা।
বর্ণাঢ্য রাজনৈতিক জীবন
১৯৪৫ সালের ১৫ আগস্ট অবিভক্ত দিনাজপুর জেলার জলপাইগুড়িতে জন্মগ্রহণ করেন খালেদা জিয়া। ১৯৬০ সালে তিনি শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের সঙ্গে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন।
রাষ্ট্রপতি জিয়ার মৃত্যুর পর ১৯৮২ সালে তিনি বিএনপিতে যোগ দেন। ১৯৮৪ সালে দলের চেয়ারপারসন নির্বাচিত হন। এরশাদবিরোধী আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়ে তিনি পরিচিত হন ‘আপসহীন নেত্রী’ হিসেবে।
১৯৯১, ১৯৯৬ ও ২০০১ সালে তিনি বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। তিনি ছিলেন দেশের প্রথম নারী প্রধানমন্ত্রী এবং তিনবারের নির্বাচিত সরকারপ্রধান।
দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনে নানা প্রতিকূলতা, কারাবরণ ও শারীরিক অসুস্থতার মধ্যেও তিনি রাজনীতি থেকে সরে দাঁড়াননি।
একটি অধ্যায়ের অবসান ঘটিয়ে বেগম খালেদা জিয়া আজ ইতিহাসের পাতায় চিরস্থায়ী হয়ে রইলেন।
