রাজধানীর কারওয়ান বাজারে গত সোমবার সন্ধ্যায় ফল কিনতে গিয়েছিলেন জেসমিন আক্তার নামের একজন গৃহিণী। ভ্রাম্যমাণ ফলের দোকানগুলোয় দেশি ও বিদেশি মাল্টার দাম যাচাই করে দেখছিলেন তিনি।
বিক্রেতার সঙ্গে দর–কষাকষি করে দুই কেজি দেশি মাল্টা ১৬০ টাকা দিয়ে কিনলেন জেসমিন। কেজি পড়ল ৮০ টাকা।
রাজধানীর কাঁঠালবাগান এলাকার বাসিন্দা জেসমিন আক্তার বলেন, ‘বিদেশি মাল্টার দাম অনেক। সব সময় কেনার মতো অবস্থা থাকে না। দেশি মাল্টা দামে সস্তা। তাই বিকল্প হিসেবে দেশি মাল্টা কিনলাম।’
রাজধানীর ভ্রাম্যমাণ ফলের দোকানগুলোয় বিদেশি ফলের সঙ্গে রাখা হয় গাঢ় সবুজ মাল্টা। বিদেশি মাল্টার দাম যেখানে কেজিপ্রতি ২৫০ থেকে ৩০০ টাকা, সেখানে দেশি মাল্টা পাওয়া যায় বাজারভেদে ৮০ থেকে ১২০ টাকার মধ্যে। কিছুদিন আগেও বিদেশি মাল্টার কেজি ৪০০–৪৫০ টাকা ছিল।
কয়েক বছর আগেও দেশি মাল্টার দাম বেশি ছিল, কেজিপ্রতি ১৫০ টাকার আশপাশে। এ বছর দাম আগের চেয়ে বেশ কম।
দেশি মাল্টা খেতে মিষ্টি, বিদেশি মাল্টার চেয়ে কম। তবে কাছাকাছি। রস কিছুটা কম। তবে বিদেশি মাল্টার তুলনায় দাম অনেক কম বলে মধ্যম আয়ের ক্রেতারা দেশি মাল্টাও কিনছেন।
যে ভ্রাম্যমাণ দোকানির কাছ থেকে জেসমিন আক্তার মাল্টা কিনেছেন তাঁর নাম মো. ইব্রাহিম। ৪০ বছর বয়সী এই ব্যবসায়ীর বাড়ি পটুয়াখালী। কারওয়ান বাজারে পাঁচ বছর ধরে ফলের ব্যবসা করেন তিনি।
ইব্রাহিম বলেন, কয়েক সপ্তাহ আগে দেশি মাল্টা বাজারে আসছে। চাহিদাও ভালো। শুরুতে সরবরাহ কম থাকায় দাম একটু বেশি ছিল। এখন কমেছে।
প্রশ্ন হলো, দেশি মাল্টা কি আসলেই দেশি? এর দাম এতটা কমল কীভাবে?
যেভাবে এল দেশি মাল্টা
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের (ডিএই) বছরব্যাপী ফল উৎপাদন প্রকল্পের সাবেক পরিচালক ও ফল বিশেষজ্ঞ মো. মেহেদী মাসুদ বলেন, মাল্টা কমলাজাতীয় ফল। পৃথিবীতে যত কমলা উৎপাদন হয়, তার ৭০ শতাংশই সবুজ।
‘যুক্তরাষ্ট্রের ফ্লোরিডাকে বলা হয় ‘দ্য স্টেট অব অরেঞ্জ’। সেখানেও উৎপাদিত কমলার ৮০ শতাংশ সবুজ। বাংলাদেশে হলুদ ও কমলা রঙের কমলা ও মাল্টা প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে’, যোগ করেন তিনি।
মেহেদী মাসুদ বলেন, ১৯৯০ দশকের দিকে ভারত থেকে প্রথম সবুজ রঙের মাল্টা বাংলাদেশে আসে। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর ও কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের যৌথ উদ্যোগে সেখান থেকে ভালো ফল বেছে নিয়ে চারা করা হয়। এরপর দেশের বিভিন্ন প্রান্তে এ চারার চাষযোগ্যতা পরীক্ষা করা হয়। চাষযোগ্যতা প্রমাণিত হলে বীজ প্রত্যয়ন এজেন্সির মাধ্যমে এটি বারি মাল্টা-১ নামে স্বীকৃতি পায়।
এরপর কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের পাঁচ বছর মেয়াদি (২০০৫-১০) সাইট্রাস প্রকল্পের মাধ্যমে পাহাড় ও সমতলে মাল্টার চাষের প্রচলন শুরু করা হয়। তবে তখনো এটির বাণিজ্যিকভাবে চাষাবাদ শুরু হয়নি—এমন তথ্য জানিয়ে সাবেক মেহেদী মাসুদ বলেন, ২০১৮ সালে বছরব্যাপী ফল উৎপাদনের মাধ্যমে পুষ্টি উন্নয়ন প্রকল্পের মাধ্যমে অন্যান্য ফলের সঙ্গে মাল্টার দেশব্যাপী প্রদর্শনীর ব্যবস্থা করা হলে এটি সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ে।
খরচ কম, রোগবালাই কম হয় এবং ভালো ফলন পাওয়া বলে সবুজ মাল্টার বাগান বাড়ছে বলে মনে করেন কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের গবেষণা শাখার পরিচালক মুন্সী রাশীদ আহমদ। তিনি বলেন, দেশি মাল্টার স্বাদ, রস ও মিষ্টতা বিদেশি মাল্টার প্রায় কাছাকাছি। তাঁরা মাল্টার আরেকটি নতুন জাত নিয়ে কাজ করছেন বলেও জানান তিনি।
কৃষিবিজ্ঞানীরা জানান, দেশি মাল্টা পাকার সময় একেক এলাকায় একেক রকম। পাহাড়ি অঞ্চলসহ সমুদ্র উপকূলবর্তী ২৪ জেলায় দেশি মাল্টা পাকে সেপ্টেম্বরের মাঝামাঝিতে। দিনাজপুরের দিকে পাকে নভেম্বরের দিকে। তবে শীত পড়া শুরু হলে দেশি মাল্টায় রস কমে যায়।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের হর্টিকালচার (উদ্যানতত্ত্ব) শাখার উদ্যানতত্ত্ববিদ মো. ময়নুল হক বলেন, বারি মাল্টা-১ এ চাষিদের কাছে জনপ্রিয়। এই ফল দেশের আবহাওয়ার সঙ্গে ভালোভাবে খাপ খেয়েছে। ফলে এর সম্ভাবনা ভালো।
উৎপাদন কতটা বাড়ল
দেশে প্রায় সব জেলায় এখন মাল্টার চাষ হয়। বছর বছর বাগান ও উৎপাদন বাড়ছে।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের হর্টিকালচারাল শাখার তথ্য বলছে, ২০১৮–১৯ অর্থবছরে দেশে মাল্টার উৎপাদন ছিল ১৭ হাজার টন, যা গত (২০২৪–২৫) অর্থবছরে বেড়ে ৮৪ হাজার টন ছাড়িয়েছেন। একই সময়ে মাল্টার বাগানের পরিমাণ ২ হাজার ৪৩৩ হেক্টর থেকে বেড়ে প্রায় আট হাজার হেক্টরে উঠেছে।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের হর্টিকালচার (উদ্যানতত্ত্ব) শাখার উদ্যানতত্ত্ববিদ মো. ময়নুল হক বলেন, পার্বত্য জেলাগুলোয় মাল্টা বেশি চাষ হয়। দেশে মাল্টা উৎপাদনে শীর্ষে আছে বান্দরবান। এরপরই রয়েছে খাগড়াছড়ি। তৃতীয় অবস্থানে আছে রাজশাহী।বান্দরবানের চিম্বুক এলাকার চার বছর ধরে মাল্টা চাষ করছেন প্রেন্তে ম্রো। তিনি বলেন, ২০২১ সালে তিনি পরীক্ষামূলকভাবে আমগাছের সঙ্গে ৫০টি মাল্টার চারা রোপণ করেন। এতে ফলন মোটামুটি ভালো হওয়ায় ধীরে ধীরে মাল্টার চারার সংখ্যা বাড়াতে থাকেন। এখন তাঁর বাগানে ২৫০টির মতো মাল্টার চারা আছে।
পাহাড়ে চ্যালেঞ্জ আছে জানিয়ে প্রেন্তে বলেন, পাহাড়ে পানির স্বল্পতা আছে। বর্ষার সময় ট্যাংকে পানি ধরে রেখে মাল্টার চাষ করতে হয়। আর দামও পাওয়া যায় কম। মধ্যস্বত্বভোগীরা কেজিপ্রতি ৩০ থেকে ৪০ টাকায় মাল্টা কিনে নিয়ে যায়। ফলে লাভ কমেছে।
মাল্টা আমদানিতে ১২০০ কোটি টাকা ব্যয়
বাংলাদেশ ফল আমদানিতে বিপুল অঙ্কের বৈদেশিক মুদ্রা ব্যয় করে। জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) তথ্য বলছে, বিগত অর্থবছরে (২০২৪–২৫) মাল্টা আমদানিতে ব্যয় হয়েছে ১০ কোটি ডলার, যা বাংলাদেশি মুদ্রায় ১ হাজার ২০০ কোটি টাকার বেশি।
মাল্টা আমদানিতে গত অর্থবছরে সরকার রাজস্ব পেয়েছে ১ হাজার ৫৫৮ কোটি টাকা। অর্থাৎ মাল্টার দামের চেয়ে সরকার বেশি টাকা শুল্ককর হিসেবে নিচ্ছে।
আমদানি ঠেকাতে সরকার ফলের ওপর উচ্চহারে কর আরোপ করে রেখেছে। মাল্টা, কমলা, আপেল ইত্যাদি ফল আমদানিতে মোট শুল্ককর ১২২ শতাংশ। মানে হলো, ১০০ টাকা দাম দেখিয়ে এক কেজি আনলে শুল্ককর দিতে হবে ১২২ টাকা।
চট্টগ্রাম কাস্টমস সূত্র জানিয়েছে, বর্তমানে এক কেজি মাল্টা আমদানিতে কেজিপ্রতি ১০৬ টাকা শুল্ককর দিতে হচ্ছে।
উচ্চ কর ও চড়া দামের কারণে স্বল্প আয়ের মানুষেরা বেশির ভাগ ক্ষেত্রে ফল কিনতে পারেন না।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) সর্বশেষ খানা আয় ও ব্যয় জরিপে (২০২২) দেখা গেছে, দেশের একজন মানুষ প্রতিদিন গড়ে ৯৫ দশমিক ৪ গ্রাম ফল খায়। এটা গড় হিসাব। ধনীরা অনেক বেশি হারে ফল খেতে পারে, গরিবেরা কম।
পুষ্টিবিদ খালেদা খাতুন বলেন, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) হিসেবে প্রতিদিন একজন পূর্ণ বয়স্ক মানুষের ১০০ গ্রাম ফল খাওয়া দরকার। সেটা দেশি ফল হলে ভালো। গবেষণায় আমরা দেখেছি, বাংলাদেশের মানুষের ফল গ্রহণের পরিমাণ ১০০ গ্রামের চেয়ে অনেক কম।